আবুজার বাবলা, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

  ১৩ মে, ২০১৮

শ্রীমঙ্গলে পাহাড়ের কান্না!

গত কয়েক বছর আগেও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের নির্জন প্রকৃতিতে সারি সারি সবুজ পাহাড়-টিলা ছিল। বাণিজ্যিক স্থাপনা, ঘরবাড়ি, চা আর ফল বাগান সৃজনের নামে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে এখানকার বেশিরভাগ পাহাড়-টিলা। এতে এখানকার উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে ।

পরিবেশবিদদের দাবি, গত ত্রিশ বছরের ব্যবধানে এখানকার ৩০ ভাগ পাহাড়ই কেটে ফেলা হয়েছে। প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে সাবাড় করলেও পরিবেশ রক্ষায় নজর নেই সংশ্লিষ্টদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭ বছর আগে ডলুছড়া এলাকায় পাঁচ তারকা মানের ‘গ্রান্ড সুলতান রিসোর্ট’ নির্মাণ করা হয় পাহাড় কেটে। অভিযোগ রয়েছে এই রিসোর্ট নির্মাণে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা যতটা সরব ছিলেন, ততটাই ভূমিকা পালনে ব্যার্থ হয় বাপা-বেলার মত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। সেই থেকে একের পর এক রিসোর্ট-মোটেল নির্মাণে নির্বিচারে শুরু হয় পাহাড় কাটা। উপজেলার মোহাজিরাবাদে উঁচু পাহাড় কেটে নির্মিত হয়েছে ‘নভেম ইকো রিসোর্ট’। সেসময় স্থানীয় প্রশাসন পাহাড় কাটায় অপরাধে অভিযুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটিকে। অভিযোগ রয়েছে ২০১৫ তৎকালীন ইউএনও প্রতিষ্ঠানটিকে সামান্য জরিমানা করে অব্যাহতি দেন। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর ‘নভেম ইকো রিসোর্টকে’ ছাড়পত্র দিতে এখন পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। একইভাবে পাহাড় কেটে রিসোর্ট-মোটেল ও গেস্ট হাউস গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে, হেরিটেজ গেস্ট হাউস, এসকেডি রিসোর্ট, হিমাচল গেস্ট হাউস, লেমন গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট, জঙ্গলবাড়ি কটেজ, শান্তিবাড়ি ইকো কটেজ এর বিরুদ্ধে।

সরেজমিনে জানা যায়, মোহাজিরাবাদে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে মসজিদ ‘জান্নাতুল ফেরদৌস’, মোহাজিরাবাদ জামেয়া উলুম মাদরাসা, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত বছর ২৫ অক্টোবর একই এলাকায় পাহাড় কেটে ‘এআরজেপি এল ফ্রুটস গার্ডেন’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও উপজেলার বিষামনী, রাধারনগর, মির্জাপুর, হোসনাবাদ এলাকাগুলোতে বেশিরভাগ প্রভাবশালীরা বাড়ি তৈরি ও মাটি বিক্রির পাহাড় কেটে উজাড় করে চলেছে। স্থানীয়রা বলছেন, পাহাড় কাটার খবর দেওয়া হলে প্রশাসনের লোকজন এসে আইন দেখিয়ে পাহাড় কাটা বন্ধ করে। কিছুদিন পর দেখা যায় আবারো সেই আগের মতোই পাহাড় কাটা হচ্ছে।

গত শুক্রবার সরেজমিন রাধানগর ঘুরে দেখা গেছে, অনেক স্থান ঘেরাও দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণযজ্ঞ চলছে। কোনটা রিসোর্ট কোনটা লজ আবার কোনটা গেস্ট হাউজ। একটি রিসোর্টে কর্মরত এক টাইলস মিস্ত্রী স্থানীয় বাসিন্দা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলের মোট জমির ৮০ ভাগই তো পাহাড়। এটা সৃষ্টিকর্তার রহমত। তবে এখানে গড়ে উঠা সব রিসোর্টের ৯৯ ভাগই তৈরি হচ্ছে পাহাড় কেটে।’

উপজেলার পশ্চিম মোহাজিরাবাদ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা পাহাড়ি খাস জমি লীজ বন্দোবস্ত নিয়ে লেবু-আনারসের বাগান সৃজনে জমি তৈরিতে পাহাড় ছেটে ফেলছে। এখানে উঁচু একটি পাহাড় কেটে স্থাপন করা মসজিদ ও মাদরাসা। এখানে ১২-১২টি পরিবার পাহাড়ের নীচে ঘরবাড়ি বানিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় বসবাস করছেন। এসব পরিবারের এক সদস্য ফারুক মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসে আশংকায় আমরা পরিবার নিয়ে খুবই দুঃচিন্তায় আছি’। ছানু মিয়া নামে আরেকজন বলেন, ‘গত বছর বর্ষা মৌসুমে ইউএনও অফিস থেকে মাইকিং করে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াব?’ এছাড়াও উপজেলার বিষামণি, রাধানগর, দিলবরনগর, ডলুছড়া এলাকায় এরকম শতাধিক পরিবার পাহাড়ের নীচে বসবাস করছেন।

এ বিষয়ে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ পরিবশে অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এখানে জনসচেতনার অভাব রয়েছে। পাহাড় কাটার ঘটনায় আমরা সব সময় সক্রিয় আছি। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও আদালতে মামলা, ঢাকাস্থ এনফোর্সমেন্ট শাখার মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘অধিদপ্তরের জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, চাইলে সবসময় সব কিছু করা যায় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও নাগরিকসমাজ সচেতন হলে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম কিং বলেন, নগরায়নের ফলে গত ৩ দশকের ব্যবধানে শ্রীমঙ্গলের ৩০ ভাগ এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ৫০ ভাগ পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। বাগান সৃজনে পাহাড়ি জমির রূপ পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া লাউয়াছড়ার গাছপালা কেটে উজাড় করায় বৃষ্টিপাত প্রবণ শ্রীমঙ্গলে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ে মারাত্মক ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। এতে করে ছড়া বেয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওর-বিল ভরাট হচ্ছে। প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকার পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখেছে। কিন্তু সেই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় পাহাড় খেকোরা ইচ্ছে মতো পাহাড় কেটে সাবাড় করছে।

পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির সিলেট বিভাগীয় চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পাহাড়ের কান্না কে শোনে? চোখের সামনেই তো পাহাড় কেটে আমাদের সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করছি। অফিসে-দপ্তরে চিঠি দিচ্ছি, কিন্তু পাহাড় রক্ষায় কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist