আজিজুল হাকিম, মানিকগঞ্জ ও তপন কুমার সরকার, আত্রাই (নওগাঁ)
বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেছেন কারিগররা
আসছে পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব। আর এই বৈশাখকে সামনে রেখে সাঁজ (পিঠা) তৈরি করছেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় শিল্পীরা। অন্যদিকে নানান রঙের ফুল তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর আত্রাইয়ের জামগ্রামের কুঠির শিল্পের কারিগররা।
অন্যান্যবারের মতো পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সাটুরিয়ায় বিভিন্ন সাঁজ তৈরিতে করছেন শিল্পীরা। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পযর্ন্ত বিভিন্ন মেলা ছাড়াও বেশি গুরুত্ব পায় পহেলা বৈশাখ। আর এ সময় সাঁজের চাহিদাও থাকে বেশি। তাই সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে তাদের। সাটুরিয়ায় বালিয়াটি ইউনিয়নের ভাটারা গ্রামে নয় বণিক পরিবারের কমপক্ষে ৫০ জন সদস্য পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে সাঁজ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো বণিক পরিবার চুলায় আখের গুড় জাল করছে। কেউ কেউ খই বিন্নি ভাজছে। আবার কেউ হাতি, ঘোড়া, বাতাসাসহ অন্য সাঁজ তৈরিতে ব্যস্ত। চুলার মধ্যে আখের গুড় জাল করে একটি ছিদ্র পাত্র দিয়ে ঢেলে বড় বড় বাতাসা, সাঁজ তৈরি করছেন।
শ্যামল বণিক জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে প্রায় ৮শ বনিক এ গ্রামে সাঁজ তৈরি করতেন। তারা সবাই ওই সময় তাঁত কাজের পাশাপাশি সাঁত তৈরি করতেন। বিভিন্ন কারণে বেশির ভাগ বণিক ভারতে চলে গেছেন। বর্তমানে এখন মাত্র ৯ পরিবার সাঁজের পেশা ধরে রেখেছেন। পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখী মেলা কেন্দ্র করে সাঁজ বেশি তৈরি ও বিক্রি হয়। বছরের ৪ মাস এ কাজ চলে পুরোদমে। বাকী মাসগুলো চলে কোন রকমে।
ননী বনিক জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই পেশায় জড়িত রয়েছেন। খাঁটি আখের গুড় ছাড়া এ সাঁজ বানানো যায় না। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আখের গুড় কিনে আনতে হয়। আর সে গুড় দিয়ে বাতাসা, সাঁজ তৈরি করতে হয়। এক মণ খাটি গুড় কিনতে ২ হাজার ৭ শ’ টাকা লাগে। এক মণ গুড় দিয়ে ৩৫ থেকে ৩৬ কেজি বাতাসা অথবা সাঁজ তৈরি হয়। প্রতি মণে লাভ হয় একশত টাকা। আর এসব বাতাসা, সাঁজ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারী ও খুচরা বিক্রয় করা হয়।
বাসুদেব বনিক জানান, পরিবারের ৭ সদস্যই সাঁজের কাজ করেন। বিভিন্ন বড় উৎসব এলে মানিকগঞ্জ, টাংগাইল,মধুপুর সখিপুর, গাজীপুর, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় সাঁজের চাহিদা বাড়ে। চিনির তৈরি মুকুট, হাতি, ঘোড়া, মাছ, নৌকা, পাখি ও লিচু করেন। আর এসব তৈরিতে প্রতি মণে খরচ হয় ২ হাজার ৭ শত টাকা। প্রতিদিন গড়ে এক মণ সাঁজ তৈরি করা সম্ভব।
স্থানীয় বালিয়াটি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রহুল আমীন বলেন, আদিকাল থেকে এই বণিকরা বিভিন্ন ধরনের সাঁজের মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। বিশেষ করে বড় উৎসবে তাদের তৈরি সাঁজের (পিঠা) উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে সরেজমিনে নওগাঁর ভোঁপাড়া ইউনিয়নের জামগ্রামে গিয়ে জানা যায়, এখানে কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে রঙিন বিভিন্ন রকমের ফুল তৈরি করেছেন স্থানীয়রা। যা তারা পহেলা বৈশাখের আগে সারাদেশে বণিকদের কাছে বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন।
গৃহিনী মোমেনা আখতার জানান, আমরা আমাদের সংসারের সব কাজ সম্পন্ন করে পরিবারের পুরুষদের ফুল তৈরিতে সাহায্য করি। কেননা ফুলগুলোতে লাভ অনেক বেশি। আগে পুরুষরা বাহিরে গেলে দুবৃর্ত্তরা মাঝে মাঝে সবকিছু ছিনতাই করে নিত কিন্তু এখন আর তা হয় না। আমাদের এই গ্রামটিকে আধুনিক মান সম্মত গ্রামে পরিণত করা প্রয়োজন।
ফুল বিক্রেতা শহিদুল ইসলামের মতে, ফুল তৈরিতে পরিবারের গৃহিণীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। কেননা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে আসছে। তাই মাস শেষে লাভের বেশি ভাগ অর্থ দিতে হয় এনজিওতে। সরকার যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেয় তাহলে এই হস্ত কুঠির শিল্পটি আগামীতে আরো বেশি সম্প্রসারিত হবে। তাই গ্রামবাসী সরাসরি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান এবাদুর রহমান বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্প। যার কদর সারাদেশে। সৌখিন মানুষ ও শিশুদের কাছে বাহারী ফুলগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। শিল্পটিকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য সরকারের কাজ করা উচিত বলে মনে করি। গ্রামের মানুষ যদি আর্থিক ভাবে সহায়তা পায় তাহলে তারা এই শিল্পটিকে আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবে। এতে সরকার এই শিল্প থেকে অনেক অর্থ রাজস্ব হিসাবে আয় করতে পারবে। অপর দিকে কারিগরদের যদি হস্ত শিল্পটির উপড় উন্নত মানের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে শিল্পটি আরো আধুনিক মান সম্মত হতো।
"