আজিজুল হাকিম, মানিকগঞ্জ

  ২২ মার্চ, ২০১৮

বিশ্ব পানি দিবস

মরে গেছে মানিকগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নদীগুলো

‘নদী আর সংগীতের জেলা’খ্যাত মানিকগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রভাবিত পদ্মা, যমুনাসহ ৯টি শাখা নদী। যে দিকেই চোখ যায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদীর শাখা-প্রশাখা। কিন্তু এর এক-দুটি ছাড়া বাকিগুলো মৃতপ্রায়। পানি না থাকায় দিনে দিনে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে পদ্মা, যমুনা, ইছামতী, কালীগঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি নদী। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশ মরুভূমির মতো হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

মানিকগঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, কান্তাবতী, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও মনলোকহানী অন্যতম। এর মধ্যে ধলেশ্বরী, পুরাতন ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা ও ইছামতী নদীরই দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পরিসংখ্যান ও তথ্য সূত্রে জানা যায়, একসময় যমুনার বৃহত্তম শাখা নদী ধলেশ্বরীর দীর্ঘ ছিল ১৬৮ কিলোমিটার। ৬৯৭ মিটার প্রশস্ত নদীর গভীরতা ছিল ৬ মিটার পর্যন্ত। বর্ষা মৌসুমে (জুলাই-আগস্ট) প্রতি সেকেন্ড আনুমানিক ২৩৩০ ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হত। শুকনো মৌসুমেও (নভেম্বরÑফেব্রুয়ারি) পানি প্রবাহ ছিল ২১.৩০ ঘন মিটার/সেকেন্ড এবং গড় গভীরতা ছিল ৩ মিটার।

১৯১০-১৪ সালে ব্রিটিশদের মানচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের যেসব নদী দিয়ে বড় নৌকা, স্টিমার, লঞ্চ, জাহাজে নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল এর মধ্যে অন্যতম ধলেশ্বরী নদী। এ নদীর গতিপথ ধরে পথে মানিকগঞ্জ হয়ে রংপুর, কুচবিহার পর্যন্ত বিভিন্ন নৌযান চলাচল করতো। আর জেলার তিল্লী, বায়রা ও সদর ছিল ব্যস্ততম বন্দর নগরী। এছাড়া মানিকগঞ্জের জনসাধারণ লঞ্চ ও স্টিমারে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নিয়মিত যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই নদীপথের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধলেশ্বরীর অববাহিকা এলাকার মানুষ কৃষিকাজ থেকে শুরু করে গৃহস্থালিসহ দৈনন্দিন সকল কাজে ধলেশ্বরী নদীর পানি ব্যবহার করত। এই নদীর পানি মেটাত তাদের তৃষ্ণা আর দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজের পানির চাহিদা। ধলেশ্বরী নদীর কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা ভুবনেশ্বর নামে যে কয়টি শাখা রয়েছে এখন আর তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ইতিহাসের বই আর বয়স্ক মানুষের মুখেই শুধু নাম শোনা যায় এই নদীগুলোর নাম।

জাগীর গ্রামের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বলেন, ধলেশ্বরী নদীর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মেঘশিমুল এলাকায় পানি দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণি আক্রান্ত হচ্ছে নানা ধরণের চর্ম রোগে। পার্শ্ববর্তী জাগীর এলাকায় বিসিক শিল্পনগরীতে কীটনাশক প্রস্তুতকারী কারখানা ‘বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজসহ এই ধরনের কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানায় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা।

বেতিলা গ্রামের কৃষক লালচাঁন মিয়া বলেন, ধলেশ্বরীর উৎসমুখ তিল্লী থেকে শুরু করে গড়পাড়া, ফুকুরহাটি, জাগীর, কৃষ্ণপুর, বেতিলা-মিতরা, আটিগ্রাম, বায়রা, তালিবপুর, সিংগাইর এবং ধল্লা ইউনিয়নের হাজার হাজার একর কৃষি জমির প্রয়োজনীয় পানির একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস ছিল এই ধলেশ্বরী ও এর শাখা-প্রশাখা। ধলেশ্বরীর উৎসমুখ তিল্লীর অংশে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমসহ প্রায় সারা বছরই নদীতে পানি থাকে না।

বায়রা গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, পানির অভাবে স্থানীয় কৃষক তিন ফসলী চাষের পরিবর্তে ভুট্টা, তামাক, সবজি চাষাবাদ করতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়ে গেছে, মাটির উর্বরতা শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকম তৃণশস্য আবাদ না হওয়ায় এলাকায় গো-খাদ্য ও জ্বালানি উৎসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

৬৫ বছর বয়সী বীরেন্দ্র রাজবংশী বলেন, ‘আমার ঠাকুরদাদা, বাবা এবং আমার পেশা ছিল মাছ ধরা। এমন কোনো মাছ নেই ধলেশ্বরীতে পাওয়া যেতো না। এমনকি বর্ষার সময় ইলিশও পাওয়া যেত এই নদীতে। কিন্তু এখন নদীই নাই মাছ পাব কোথায়! আমাদের গ্রামে দুই একজন মাছ ধরতে যায় দূরবর্তী স্থানগুলোতে। বর্তমানে সেখানেও তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।’ ধলেশ্বরীর বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হতে চলেছে রাজবংশী সম্প্রদায়ের বংশীয় পেশাটি।

সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু অনেকটা আক্ষেপ করে জানান, মানিকগঞ্জের নদীর ইতিকথা। নদীর এ করুণ মৃত্যুকে মাতৃশোকের সমতুল্য মনে করেন। তিনি বলেন, এখনো সময় আছে নদীগুলোকে বাঁচানোর। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব নদী পুরোপুর হারিয়ে গেলে তা হবে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়।

স্যাক সভপতি দীপক কুমার ঘোষ বলেন, একসময় ঝিটকা, ঘিওর, জাবরা, বালিরটেক, সাটুরিয়া, বায়রা, উথুলী , বরুন্ডী, দৌলতপুর ও লেছড়াগঞ্জসহ অর্ধশতাধিক হাটবাজার নৌপথে যাতায়াতই ছিল সহজ। কিন্তু নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় এসব হাট-বাজারে পণ্য পরিবহনে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নদী মাতৃক দেশ নদীকে রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করা। এ ছাড়া সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, ধলেশ্বরী নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর উৎসমুখ পরিদর্শন, নদী দিসব পালন, স্মারকলিপি দান, পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। এ জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আশা করছি।

এ ব্যাপারে সদ্য বদলি হওয়া পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, ঘিওর উপজেলার জাবরা থেকে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারি পর্যন্ত প্রায় ৩৮ কিলোমিটার নদীখননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাবিউটিএ) মানকিগঞ্জ সদর উপজেলার তরা থেকে সিংগাইর উপজেলার হজরতপুর পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার নদীখননের কাজ করছে। তবে তিনি বলেন, ‘শুধু মানিকগঞ্জ অংশের নদীগুলো খনন করলেই হবে না। যেসব এলাকা দিয়ে এই নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে তার সব জায়গাতেই খনন করতে হবে। তা না হলে সেই খনন টেকসই হবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist