আশরাফুল আলম, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ক্রোড়িবাড়ী টাঁকশাল
প্রাচীন বাংলার রাজধানীখ্যাত ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের এক সময়ের বিত্তবৈভব আর জৌলুসের খ্যাতি ছিল। প্রাচীন নগরীর ভগ্ন ইমারতগুলো এখনও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। সমৃদ্ধ এ নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটি মুদ্রার প্রচলনও। প্রচলিত এ মুদ্রাগুলো তৈরি হতো সোনারগাঁয়ের মহজমপুর টাঁকশাল ও আমিনপুরের ক্রোড়িবাড়ী টাঁকশালে। জামপুর ইউনিয়নে মহজমপুরের টাঁকশালটি ইতিমধ্যে অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। অযতœ, অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে অন্যটিও ধবংশের দ্বারপ্রান্তে।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সোনারগাঁয়ের বর্তমান জামপুর ইউনিয়নের মহজমপুরে ১৬৬০ শতকে সুলতানি শাসনের শেষ দিকে শাহী লঙারের মসজিদ ও এতিমখানা ছিল। এখনো মসজিদটি রয়েছে। ওই আমলেই মহজমপুরে টাঁকশালটি ছিল। শাহী বংশের শাসনামলে ওই টাঁকশালে অনেক মুদ্রা মুদ্রিত হতো। সোনারগাঁয়ে ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমল শুরু হয় ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে। শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ ছিলেন এ বংশের প্রথম শাসক। ইলিয়াছ শাহী আমলের অন্যতম শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তার আমলেই সোনারগাঁয়ে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন ঘটে। ঐহিত্যবাহী এ পুরাকীর্তিটি দেখভালের কেউ নেয়। ফলে টাঁকশালের মালামালসহ বেশিরভাগ অংশ বিলীন হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরের কাছে স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ক্রোড়িবাড়ীর টাঁকশাল। প্রায় চার শতাব্দীর পুরনো টাঁকশালটি এখন পরিত্যক্ত একটি ভবন।
সোনারগাঁয়ের ইতিহাস, জেলা বাতায়ন ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গৌড়ীয় দোচালা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ টাঁকশালটির চারদিকে রয়েছে পাতলা জাফরি ইটের উচু দেয়াল, যা দেখলেই অনুমান করা যায় এ স্থানটি তৎকালীন সময়ে একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিল। টাঁকশালটির উত্তরে রয়েছে বিশাল দীঘি। এক সময় দীঘির চারদিকে বিশাল আকারের শান বাঁধানো ঘাট ছিল। বর্তমানে ঘাটের কোন অস্থিত্ব নেই। তবে দীঘিটি আগের মতোই রয়েছে। স্থানীয়রা আমিনপুরের এ টাঁকশালটিকে ক্রোড়িবাড়ি বলে থাকে। মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে পরগনার রাজস্ব অধিকর্তা ও রাজস্ব সংগ্রাহকের পদবি ছিল ক্রোড়ি। ধারণা করা হয়, সে থেকেই এ বাড়ির নাম হয় ক্রোড়িবাড়ি। ভূগর্ভস্থ কুঠরিগুলোতে সরকারি মুদ্রা ও সোনার মোহর রাখা হতো বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট আকবর ও শেরশাহের আমলে এ ভবনটি ছিল ট্রেজারার হাউজ। সম্রাট শেরশাহের আমলে প্রচলিত মুদ্রাগুলো ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশালে মুদ্রিত হতো। ঐতিহাসিক স্বরূপ চন্দ্র রায় সূবর্ণগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সামসুদ্দিন আবুল মুজাফফর শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা সোনারগাঁয়ে মুদ্রিত হয়েছিল। তাছাড়া ঐতিহাসিক ব্রাডলি বার্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থে ‘রোমান্স অব অ্যান ইস্টান ক্যাপিটালে’ ক্রোড়িবাড়ির নাম উল্লেখ করেছেন।
রশিদ, রিপন চন্দ্র ও দিপ্ত গাঙ্গুলী নামে আমিনপুরের তিন প্রবীণ জানান, দুটি টাঁকশালের মধ্যে একটি বিলীন হয়ে গেলেও জরাজীর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশালটি। এটি সংস্কারে সরকারিভাবে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। সোনারগাঁয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এ টাঁকশালটির ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। তাই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তাদের। ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশাল ঘুরে দেখা যায়, ভেতরে নেই কোনো ধরনের আসবাব অথবা যন্ত্রপাতি। জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায় এ টাঁকশালের বাইরে জন্মেছে ছোট-বড় গাছগাছালি। একই অবস্থা ছাদে। গত কয়েক বছরেও কোনো পর্যটক টাঁকশালটি দেখতে এসেছে বলে মনে হয়নি। আশপাশেও নেই কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশাল থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দুরত্ব সোনারগাঁ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বাবুল মোশারফের বাড়ির। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সোনারগাঁয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন দুটি টাঁকশালের মধ্যে একটি অনেক আগেই অযতেœ অবহেলায় ধবংস হয়ে গেছে। ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশালটি সংস্কার করে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত।
সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিএম রুহুল আমিন জানান, প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য টাঁকশালটি সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পুনরায় সংস্কার করে টাঁকশালটি দেখার জন্য পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হবে।
নারায়ণগঞ্জ-৩ সোনারগাঁ আসনের সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, সোনারগাঁয়ের পুরাতন ঐতিহ্যের টাঁকশালটিকে সংস্কার করার জন্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলেই সংস্কারের কাজ শুরু করা হবে।
"