শহিদুল ইসলাম সোহাগ, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া)

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ভর্তুকির সারে কুষ্টিয়ায় বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ!

কুষ্টিয়ার মাঠ জুড়ে সবুজ আর সবুজ। কিন্তু এর কোনটাই খাদ্যশস্য বা সবজি নয়। নিরীহ সবুজের ভেতরে মাঠে মাঝে বিষ ছড়াচ্ছে তামাক গাছ। ফসলের মাঠে কৃষি অধিদপ্তরের কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও মিলবে তামাক উৎপাদনে সংশিষ্ট কোম্পানীগুলো মাঠ কর্মীদের। ফলে দৌলতপুর উপজেলার প্রায় ৬৫ ভাগ জমিতে গ্রাস করে চলছে তামাকের আবাদ। বিএডিসির সেচ স্কীমগুলোতেও ব্যাপক হারে হচ্ছে এর চাষ। এমনকি কৃষির জন্য বরাদ্দ সরকারি সার গোপনে চলে যাচ্ছে এই কাজে।

কুষ্টিয়ার মাটি ফসল চাষের জন্য উর্বর হওয়ায় এখানেই উৎপাদন হয় উৎকৃষ্ট জাতের তামাক। ফলে বড় বড় তামাক উৎপাদনকারী, প্রক্রিয়াজাতকারী, বিড়ি, সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলো এই এলাকায় জেঁকে বসেছেন। মাঠের পর মাঠ শুধু তামাকের চাষ হলেও এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই খোদ কৃষি অফিসে।

জেলা কৃষি স¯প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কুষ্টিয়া জেলায় সর্বমোট আবাদি জমির পরিমান ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৭৮ হেক্টর। এর মধ্যে গত মৌসুমে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল প্রায় ৩৩ হাজার ৮৫২ হেক্টর জমিতে। এছাড়া গম ১১ হাজার ১৩০ হেক্টর, ভুট্টা ২০ হাজার ৯০০ হেক্টর, আলু ২ হাজার ৮০৬ হেক্টর, মিষ্টি আলু ৩৬৪ হেক্টর, সরিষা ৬ হাজার ৬৯০ হেক্টর এবং ৬ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয়। এর পাশাপাশি ১৩ হাজার ২৭৬ হেক্টরে তামাক চাষ হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তামাক কোম্পানীগুলোর তথ্য মতে, প্রায় ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানীর একাধিক মাঠকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর কুষ্টিয়া অঞ্চলে আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানী প্রায় ৯ হাজার হেক্টর, ঢাকা টোব্যাকো ১৫ হাজার, জামিল টোব্যাকো ১২শ এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে আরো ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে, যা মোট আবাদী জমির প্রায় অর্ধেক।

এ দিকে সরকার তামাক চাষে ভূর্তুকী না দিলেও তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানীগুলো তাদের সুপারভাইজারদের মাধ্যমে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসের প্রায় সমস্ত সার বি.সি.আই.সি ডিলারদের কাছ থেকে গোপনে কিনে নিয়েছে বলে সংশিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কারণ, এই সময়ে অন্যান্য ফসলে সারের তেমন চাহিদা নেই, তামাক চাষীদের নিকট ভুর্তর্কীর সার বিক্রয় করা হলেও সার ডিলারদের তদারকি কর্মকর্তারগণ এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে। ফলে সরকারের বিপুল পরিমান অর্থ গচ্ছা যাচ্ছে।

তামাক চাষে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা কুষ্টিয়ার বৃহত্তর দৌলতপুর উপজেলায়। এই উপজেলায় ৩৩ হাজার হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হচ্ছে। যেখানে প্রায় দুই লাখ টন খাদ্য শস্য উৎপাদন সম্ভব হতো। পদ্মার পাড়ে ৪টি চরাঞ্চল ইউনিয়নে সম্পূর্ণরূপে তামাক চাষের দখলে। ফলে এখানকার জমির বর্গা মূল্যও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের মানিকদিয়া গ্রামের কৃষক মেহের ইসলাম তার ৪ বিঘা জমি ব্রিটিশ-আমেরিকার টোব্যাকোর কাছে বর্গা দিয়েছেন। তিনি জানান, তামাক চাষকালীন সময়ের জন্য প্রতি বিঘা জমি ১৪-১৫ হাজার টাকায় বর্গা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে একবিঘা জমিতে তামাক চাষে বীজ, সার, কীটনাশক ও পরিচর্যাসহ মোট ব্যয় হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা যা তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানী স¤পূর্ণ বহন করে এবং তারাই সব দেখভাল করে। ইউনিয়নের কৃষকদের অভিযোগ, উপজেলা কৃষি অফিসের ব্লক সুপারভাইজার বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নামকাওয়াস্তে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা, বা কথা না বললেও খাতাপত্র ঠিক রাখেন।

এ ব্যাপারে দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার কোন চেষ্টা সফল হচ্ছে না। তামাক কোম্পানীগুলো চাষীদের ইনসেনটিভ দেয়ার কারণে তারা তামাক চাষে বেশী আগ্রহী হয়ে পড়েছে। তবে, চিলমারী ইউনিয়নের সার ডিলার আসাদুল হক পুটু সহ কয়েকজন প্রভাবশালী সার ডিলার তাদের নির্দেশনা অমান্য করে তামাক চাষীদের নিকট সার বিক্রয় করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

খাদ্য শস্য উৎপাদনে আসা সরকারি সার গোপনে তামাক চাষে চলে যাওয়া অনুসন্ধানে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। জেলার মোট সার ডিলার ৭৫ জন। এরমধ্যে দৌলতপুর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে আছে ১ জন করে ডিলার। তাদের প্রত্যের অধীনের একাধিক সাব-ডিলার কাজ করে। কিন্তু বাস্তবে এই সাব-ডিলারদের কাছে সার পৌঁছায় না। চিলমারী ইউনিয়নের গিয়ে বিএডিসি কোনো সার গোডাউন বা সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ এই গোডাউন থেকেই সারা বিলি হওয়ার কথা। ইউনিয়নের সার ডিলার আসাদুল হক পুটুর অধীনে থাকার চার সাব-ডিলার মিন্টু, কহি মোল্লা, সাদ্দাম হোসেন ও মকবুল জানান, গত দুইÑআড়াই বছরে ধরে তারা কোনো সার পান না। এমনকি কবে সার আসে তা তারা জেন না। তবে ৩ বছর আগে তারা কিছু কিছু সার পেতেন বলে স্বীকার করেন।

সার ডিলার আসাদুল হক পুটু মুঠোফোনে সাব-ডিলারদের মাঝে সার বণ্টনের কথা উল্লেখ করলেও তারা তা অস্বীকার করেন। পরে সার না দেওয়ার অযুহাত হিসেবে সাব-ডিলারদের কাছে সাড়ে চার লাখ টাকা বকেয়া দাবী করলেও একই ভাবে সাব-ডিলাররা তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেন।

ব্রিটিশ-আমেরিকা টোব্যাকোতে সরকারের শেয়ার থাকার কথা উল্লেখ করেন জেলার তামাক বিরোধী সংগঠন সাফ-এর নির্বাহী পরিচালক মীর আব্দুল রাজ্জাক বলেন, ‘খোদ আইনের এর সীমাবদ্ধতা আছে। দেশে বিদ্যমান আইন আছে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন নেই।’ তিনি খাদ্যশস্য চাষের জন্য সরকারের ভর্তুকির সার তামাক চাষে ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান করেন।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. গোলাম মর্তুজা বলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন তামাক চাষের ফলে কুষ্টিয়ায় আর কোন ফসলের চাষ করা সম্ভব হবে না। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং খাদ্য জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এখনই তামাকের চাষ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ অঞ্চলে তামাক চাষ বৃদ্ধির ধারা যেভাবে উর্ধমুখী হচ্ছে, এরফলে অদুর ভবিষ্যতে কুষ্টিয়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist