ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

  ১৭ মার্চ, ২০২০

বঙ্গবন্ধুর আত্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার

মার্চ মাস এলেই আনন্দের পাশাপাশি বেদনা উঁকিঝুঁকি মারে; আবার এক ধরনের আতঙ্ক অনেককে পেয়ে বসে। এ আতঙ্কের কোনো নির্দিষ্ট নাম দেওয়া না গেলেও তাকে মার্চ আতঙ্ক নামে অভিহিত করছি। যারা এ আতঙ্কে ভোগেন ও কাবু হন তাদের চেনা কঠিন। তাদের মধ্যে যেমন আছে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, পাকিস্তানি এজেন্ট; তেমনি আছেন এমন কিছু ব্যক্তি যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ না করেই বিভিন্ন কারণে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের পোশাকি পরিচিতি হচ্ছে রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী। একুনে তাদের পরিচয় হচ্ছে জাতীয়তাবাদী; যাদেরকে পরিকল্পিত পরিচর্যায় সুচ থেকে ফালে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

মার্চ মাসে যাদের ঝোলা শূন্য, তারা হয়তো স্বপ্নালোকের হাতছানিতে আর যাদের সামান্য কিছু আছে তারা শূন্য কলসির মতো ঢকঢক শুরু করে। এটাই আতঙ্কগ্রস্ততার লক্ষণ। তাদের আতঙ্কটা উৎকণ্ঠায় রূপ নেয়, আর উৎকণ্ঠা থেকে আক্রোশ, আক্রোশ থেকে আক্রমণাত্মক বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখাজোখা বের হতে থাকে। এ মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের বলার ও লেখার অনেক কিছু থাকলেও তারা সীমিত গ-িতে বিচরণ করে। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় তারা বলেছেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা চায়নি, ছাত্রদের ও বেগম মুজিবের প্রচ- চাপেই শুধু মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছিল। প্রমাণ হিসেবে বিরুদ্ধবাদী ছাত্র ও যুব নেতৃত্বের কণ্ঠনিঃসৃত বাক্যগুলোই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে উচ্চারিত কথাগুলোও পরিবেশিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তাদের আর কে পায়! বাঙালি, বঙ্গবন্ধু, এমনকি বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করতে কোমর বেঁধে তারা মাঠে নামে। বাঙালিকে কলমের খোঁচায় বাংলাদেশি করে ফেলা, পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ প্রচলন করা এবং স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কটি বেগবান করে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ম্লানের প্রয়াস তারা চালায়। চুটিয়ে প্রচার করা হয়, জেনেশুনেই মুজিব কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করলে জিয়াউর রহমানের ডাকে সারা জাতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে!

জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় শেষোক্ত বিতর্কটি তেমন জমেনি। ইতিহাস ও জিয়া লিখিত স্বীকারোক্তিকে অস্বীকার করা যায়নি বলে বাড়াবাড়িটা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, বিশেষত খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় তারা ২৭ মার্চকে ২৬ মার্চ বানিয়ে বসে। একটা ড্রামতত্ত্বও উপস্থাপন করা হয়। এমনকি মেজর জিয়াকে মেজর জেনারেল জিয়ার পোশাক পরিয়ে কোনো এক ২৬ মার্চে পোস্টার ছাপানো হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, আরেকটা সুযোগ পেলেই জিয়া শুধু ঘোষকই নন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের পিতৃপুরুষে রূপান্তরিত হতেন! এগুলো নিঃসন্দেহে কোনো কর্ম নয়- স্রেফ অপকর্ম, বক্তব্য বা কলমবাজি, যার তথ্যের উৎস হচ্ছে ১৯৭১ সাল।

১৯৭১ সালে আমাদের পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ের কর্ম ও বক্তব্য ছিল। পাকিস্তানিদের বক্তব্য ছিল শান্ত, মার্জিত, সুশীল ও আত্মরক্ষামূলক; আর কর্ম ছিল অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক ও বর্বরোচিত। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা-টি মাটিচাপা দেওয়া কিংবা তার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য এগুলো তাদের প্রয়োজন ছিল। অপরদিকে বাঙালিদের কর্মও ছিল আক্রমণাত্মক আর বক্তব্য ছিল আত্মরক্ষামূলক। তাই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও উভয়ের আচরণে একটা অদ্ভুত মিল ছিল। উভয়ের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনমত পক্ষে রাখা। সে কারণে যে কথা সেদিন বা পাকিস্তান আমলে বললে মহাসর্বনাশ হয়ে যেত, মুক্তিযুদ্ধের পর সেগুলোই আমরা তার স্বরেই বলছি। পরিস্থিতি বা অবস্থানের পরিবর্তনের কারণেই যে তা ঘটেছে, বলাই বাহুল্য।

আগেই বলেছি, আমাদের দেশের কিছু বক্তা ও লেখক মার্চ এলেই আলাপ-বিলাপ, প্রলাপ বকতে শুরু করে, তাদের কিছু তথ্য ও যুক্তির উৎস হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাঙালি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পরিবেশিত বিভিন্ন আত্মরক্ষামূলক বক্তব্য ও লেখালেখি। বাঙালিরাও পাকিস্তানিদের দলিল-দস্তাবেজের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিপক্ষের বক্তব্য খ-নের প্রয়াসী হয়। এসব করতে গিয়ে নিরপেক্ষতা বা বস্তুনিষ্ঠতা যে সব সময় রক্ষিত হয়, তা বলা কঠিন। বস্তুত নিজেকে শান্ত-ভদ্র-সুশীল, উৎপীড়িত, নির্যাতিত, দুর্বল ও অন্যায় আচরণের শিকার প্রমাণ করতে যেসব তথ্যের জোগান বা প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়, তা বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে। তাই এসব তথ্যের সাহায্যে নয়, স্রেফ মানব-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায়, বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বাধীনতার একাগ্র সাধক ছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমার এ কথা প্রমাণের আগে প্রতিপক্ষের বক্তব্যই প্রথম তুলে ধরছি।

প্রথমে যদি ধরেও নেই বঙ্গবন্ধু চাপে পড়ে বা বলতে গেলে এক ধরনের বাধ্যবাধকতার কারণেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, যদিও পাকিস্তানি ও বিশ্ব দলিল-দস্তাবেজে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা আছে। বাধ্যবাধকতার কথা এলেই তার সীমা ও পরিসীমাও নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখা, ছাত্র সম্প্রদায় বা বেগম মুজিবের চাপ এ বাধ্যবাধকতার সীমা-পরিসীমা নির্ধারক। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়ে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন, পাকিস্তানিদের কব্জায় চলে গেলেন। কেউ হয়তো বলতে পারে বন্দি হননি, আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যাহোক, তিনি ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হলেন; বেগম মুজিবের প্রভাবমুক্ত হলেন; নির্জন সেলে নীত হলেন; পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হলেন; পূর্ব পাকিস্তানে যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তাও তিনি সঠিক জানতে পারলেন না। পাকিস্তানে বন্দিদশায় তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি হয়তো, কিন্তু একটি সমঝোতায় আসার জন্য তার ওপর প্রচ- মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। একটি আপসরফার জন্য তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার কবর খোঁড়া হয়। এই সীমাহীন আঁধারের প্রান্তসীমায় ছিল

ফাঁসির মঞ্চ, নয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব।

বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন তিনি স্বাধীনতা চাননি, অতএব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া অবান্তর অথবা যদি বলতেন প্রাণ বাঁচাতে প্রচ- চাপের মুখেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাহলে তিনি নির্জন সেল থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসে যেতে পারতেন। আমার যদি এমন অবস্থা হতো বা আমি কিংবা পাঠক যদি এমন অবস্থায় পড়তেন তাহলে আমরা কী করতাম? সাধারণ মানুষের প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার কাছে মৃত্যুর চেয়ে জীবন অধিকতর কাম্য; ব্যতিক্রম ১৯৭১ সাল যখন মৃত্যুর জন্য নির্বিবাদ প্রতিযোগিতা দেখেছি। তার সঙ্গে যদি প্রধানমন্ত্রিত্ব যোগ হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। বঙ্গবন্ধুও আমাদের মতো মানুষই ছিলেন। তবে তিনি যদি শুধু শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের পিতা হতেন কিংবা কেবল আমাদের কারো বন্ধু হতেন, তাহলে পাকিস্তানিদের দেওয়া সবকটি শর্ত মেনে নিতেন। এমনকি নিজের অপরাধ স্খলনের জন্য কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের দায়ভার অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারতেন। হয়তো বঙ্গবন্ধু এমনটি করবেন ভেবে মোশতাক-কাইউমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনটি করেননি। তার কর্মের সব দায়ভার তিনি নিজে বয়েছেন।

মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আজীবন সংগ্রামী ও আপসহীন মানুষটি আপসের চোরাবালিতে পা রাখেননি। তাই আজ আমরা স্বাধীন, আমাদের স্বকীয়তায় আমরা ভাস্বর; আমরা একটি মর্যাদাশীল জাতি। হয়তো পাঠক ভাববেন বা তর্কও জুড়ে দিতে পারেন যে, জনগণের ভয়ে তিনি আপস করেননি। যুক্তি বটে, কিন্তু সেদিনের বঙ্গবন্ধুকে যারা দেখেছেন বা চিনেছেন

তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, তার ইশারায় সব অসম্ভব সম্ভব হতো। সেদিন মনে হতো তার কথায় সাগরের তরঙ্গও শান্ত শিশুর মতো কূলে উপচে পড়ছে, বাতাস স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনছে, তার হুঙ্কারে নদীর কলধ্বনি থেমে যাচ্ছে। তার কথায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি উঠত, বসত, হাসত, কাঁদত, গড়াগড়ি দিত আর অম্লান বদনে আত্মাহুতি দিত। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যা চাইতেন তাই হতো। তিনি যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের ভারত থেকে দেশে ফেরার আহ্বান জানাতেন, তাহলে কজন দালাইলামা বা কাঞ্ছাকাঞ্ছি খুঁজে পাওয়া যেত? কিন্তু বঙ্গবন্ধু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি; তাদের চিরকাক্সিক্ষত স্বাধীনতায় চিড় ধরাননি। তারপর ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যদি তিনি ভুট্টোর কনফেডারেশনের দাবি মেনে নিতেন তাতে কেউ কেউ বিক্ষুব্ধ হতেন, বক্তৃতা-বিবৃতি চলত; তবে শেখ মুজিবের টিকি স্পর্শের ক্ষমতা কারো ছিল না। অর্থাৎ তিনি যদি স্বাধীনতা নাই চেয়ে থাকতেন, তাহলে তার দায়বদ্ধতা এড়ানো কিংবা অন্যের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অনেক লগ্ন ও মোক্ষম সুযোগ ছিল। তিনি তা করেননি। পাঠক, একটু নির্জনে বসে ভাবুন এবং বলুন বঙ্গবন্ধু কে এবং কী ছিলেন; কী দিয়ে আমরা তার ঋণ শোধ করব?

ঋণ শোধের সময় বয়ে যায়নি। একটি লগ্ন সামনে আছে। আসুন এবারে তার আত্মদিনে টুঙ্গিপাড়ায় বা ৩২ নম্বরে গিয়ে নীরবে হলেও বলি, ‘পিতা, আমরা তোমার অর্বাচীন বা অকৃতজ্ঞ সন্তান। তাই তোমার ত্যাগ, তোমার প্রেম ও তোমার মহত্ত্বকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। তোমাকে ছোট করতে গিয়ে নিজেদের ছোট করেছি, ভবিষ্যতে আমি বা আমরা এমনটি আর করব না।’ তাহলে এটাই হবে বঙ্গবন্ধুর আত্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।

লেখক : শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close