অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান

  ১৭ মার্চ, ২০২০

বঙ্গবন্ধু ও ছাত্ররাজনীতি

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঐতিহ্য, সফলতা, সংগ্রাম, আন্দোলন, গৌরব ও বিজয়গাথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি নামÑ শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের আগস্ট কলকাতার প্রগতিশীল তরুণ নেতা শেখ মুজিব তার সমমনাদের নিয়ে চলে এলেন ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৪ সাল থেকেই ঢাকায় ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতার সক্রিয় অংশগ্রহণে খাজা নাজিমউদ্দীন এবং আহসান মঞ্জিল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ধারা গড়ে ওঠেছিল। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের পাকিস্তান তথা পূর্বপাকিস্তান কালের রাজনৈতিক কর্মকা-ের শুরু ১৫০ নম্বর মোগলটুলির ‘পার্টি হাউস’ থেকে। তার সমকালীন রাজনৈতিক সহযোগী তরুণ রাজনীতিক কমরুদ্দীন আহমদ তার গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস গঠন করা হলো ১ এপ্রিল, ১৯৪৪ সালে ঢাকার ১৫০ নম্বর চক মোগলটুলিতে। তিনতলা বাড়ির নিচতলায় কাগজের দোকান হায়দার সাহেব নামে এক ভদ্রলোকের। দোতলায় অফিস আর তিনতলায় সর্বক্ষণ কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং কনফারেন্স রুম।’ ১৯৪৭ সালের আগস্টের পর ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা একত্রিত হতে থাকেন।

এই অফিসটি ঢাকায় অবস্থিত থাকলেও সারা পূর্ববাংলায় নাজিমউদ্দীন সরকারবিরোধী যুবকরা রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের প্রাথমিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ১৯৪৩-এর আগস্টের পর শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, মুহম্মদ আলমাস, মোহাম্মদ আউয়াল প্রমুখ নাজিমউদ্দীনবিরোধী তরুণ কর্মীরা এই অফিসকে কেন্দ্র করে ‘পূর্ববাংলার নতুন রাজনীতি গঠন’ চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সমমনা সাথীরা কলকাতা থেকে এসে সেই রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করেন।

কমরুদ্দীন আহমদ তার গ্রন্থে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে থাকে এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মোগলটুলি অফিসে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। শামসুল হক সাহেব ওই ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কনভেনর হন।

ছাত্রকর্মীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর কারণ বিশ্লেষণে কমরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘শেখ সাহেব শামসুল হকের তুলনায় সে যুগে অনেক বেশি বাস্তবধর্মী ছিলেন, তিনি প্লেটোর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিমূর্তি ছিলেন না। তিনি সেই যুবক বয়সেও অ্যারিস্টেটলের মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা প্রতিমূর্তির মতো ছিলেন। আদর্শের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি তার দৃষ্টি ছিল বেশি। শেখ সাহেব তত্ত্বের বা মতবাদ প্রচারের চেয়ে বাস্তব জীবনের সংগ্রামে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাত্ত্বিক আলোচনার সময় ব্যয় না করে কর্মরত থাকায় বিশ্বাস করতেন। তার চোখে-মুখে একটা দীপ্তি ছিল। কর্মীদের মধ্যে, ভবিষ্যৎ যে তার হাতের মুঠোয় আসতে বাধ্য সে বিশ্বাস জন্মানোর ক্ষমতা তার ছিল, যেসব কর্মী তার সান্নিধ্যে যেত তাদের সঙ্গে একটা কল্পনার সুখী সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি করার শক্তি ছিল।’

যে সংগঠনটি ‘তৎকালীন পূর্ববাংলায় আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তনের’ শুভ সূচনা করে, ছাত্র যুব কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে এবং যা গঠনে শেখ মুজিব তার সমমনা তরুণদের সঙ্গে মিলে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা হলো গণতান্ত্রিক যুবলীগ। প্রকৃতপক্ষে এই সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৪২ সালে কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হলে। শেখ মুজিব, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ তৎকালীন ছাত্র ও যুবকর্মীরা পাকিস্তানে এবং বিশেষ করে পূর্ববাংলায় তাদের রাজনীতির ধারা ঠিক করার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়ে যে আলোচনা করেন, সিদ্ধান্ত নেন তারই ধারাবাহিকতায়। ‘পূর্ববঙ্গ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই বৈঠকটি ছিল ঐতিহাসিক। কারণ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার উপযুক্ত সংগঠন গড়ার জন্য এই বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।’

দেশ বিভাগের (১৯৪৭) পরপরই যারা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী, জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন আহমেদ, কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী আহমেদ কামাল প্রমুখ। তারা সবাই ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। শেখ মুজিব ঢাকায় এসেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত হন। শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, নইমুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং অলি আহাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের এখানেই ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। মুজিব ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই সময় পূর্ববাংলায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত হয়। শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজনীতিতে তখন তরুণরা সক্রিয়, বলিষ্ঠ এবং অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন তাই এসব ঘটনা তাদের মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এদের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তরুণদের বিদ্রোহী করে তোলে। এর ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ওই সময় পূর্ববাংলার প্রতি পাকিস্তান সরকারের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ববাংলার ছাত্রনেতাদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করে।’

ছাত্রলীগের জন্ম পূর্ববাংলার শুধু ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ১৯৪৭-পূর্ব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বলিষ্ঠ অবস্থান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close