কাইয়ুম আহমেদ

  ১৭ মার্চ, ২০২০

খোকা থেকে যেভাবে বঙ্গবন্ধু

‘রুপালি নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল, ও তোর রূপের সোনার নয়ন কোনায়, নামছে রূপের ঠলে রে রুপালি নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’... চারিদিকে জল থই থই-বুকে পালতোলা পানশি নৌকা চলা এই নদীর নাম মধুমতি। যার তীরে ‘অবারিত সবুজের প্রান্ত ছোঁয়া’ এক গ্রাম; টুঙ্গিপাড়া। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই গ্রামের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় ফুটফুটে এক শিশুর। বাবা-মা আদর করে তার নাম রাখেন খোকা। গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধ মেখে বেড়ে ওঠেন তিনি। মধুমতির রূপে-মুগ্ধ হন খোকা; গড়ে ওঠে দারুণ সখ্য। লতা-গুল্ম, সোনা রোদ বিছানো বিস্তৃত ধান খেত, দুপুরের সুনসান নীরবতায় হঠাৎ ঘুঘুর ডেকে ওঠা, ঝিঁঝিঁর বিরামহীন রাতভর গুনগুন ধ্বনিÑ সবকিছুই তার চেনা। তাই তো তিনি অনায়াসেই ছুঁতে পেরেছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে; হয়েছেন মুক্তির মহানায়ক। তিনি আর কেউ নন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের বন্ধু। বাংলার জনগণের জন্য ছিল তার অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা। পরিবার পরিজনসহ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তিনি বাংলার মাটি-মানুষের কত আপন ছিলেন। অসহায় দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাকে ভাবিয়ে তোলে, তাদের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তার মন ভরে ওঠে। বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষায় লড়াকু হয়ে ওঠেন। তার সব সত্তা জুড়ে ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের আকুতি, বাঁধভাঙা মুক্তির আকাক্সক্ষার কাব্য। তিনি পিছু হটেননি, দাঁড়িয়েছেন, লড়েছেন, জয় করেছেন। তিনি কোনো শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।

ঘটনা এক : দিন যায়, মাস যায়। খোকা বড় হয়। দেখতে দেখতে তাকে স্কুলেও ভর্তি করা হয়। এক দিন স্কুল থেকে সেই খোকা বাড়ি ফিরল শরীর চাদরে মুড়িয়ে। মা জিজ্ঞাসা করলেন, পুরো শরীর চাদর মুড়ি দেওয়া কেন? কী হয়েছে খোকা? কই কিছু হয়নি তো! ছেলের ভাবলেশহীন উত্তর। তোমার জামা-পাজামা কই? তখন ছেলে বলল, ‘মা স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম একটি ছেলের গায়ে কোনো জামাকাপড় নেই। এই শীতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলÑ তাই আমার জামা-পাজামা খুলে ওকে পরিয়ে দিয়ে এসেছি। ছেলেটা কি যে খুশি হয়েছে!’ মা একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলের কা- দেখে! তারপর আবার কি যেন ভেবে পরক্ষণেই গর্বে বুক ভরে উঠল মায়ের; কত উদার হয়েছে ছেলেটা তার। পরোপকার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তার সাধারণ গুণ। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় তিনি যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন, তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলেও প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন।

আরেক ঘটনা : খোকার বয়স যখন মাত্র ১৩, তখন গোপালগঞ্জে স্বদেশি আন্দোলনের সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ দেখে বিক্ষুব্ধ হন। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন এই খোকাও বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীদের দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তারা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের, যা শিশু মুজিবের প্রতিবাদের বিরল দৃষ্টান্ত।

কৈশোরে বুদ্ধি : একবার বাংলার বাঘ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আসবেন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে। শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় তাকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভালো লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন এবং দুর্জয় সাহস নিয়ে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সংগ্রাম-আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে দমাতে বারবার কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা করা হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ আনে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং গুটিকয়েক সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। ৩৫ জন আসামির সবাইকে পাকিস্তানি সরকার গ্রেফতার করে। মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে সাজা দেওয়ার পরিকল্পনা টের পেয়ে বাঙালি জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্র-জনতার মিছিলে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। গণ-আন্দোলনে নতিস্বীকার করে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সব আসামিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন।

যেভাবে পেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি : এই ঘোষণায় ১৯৬৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন, যা ইউনেসকোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল তার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। ওই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি তার ধানমন্ডির বাড়িতে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তার দূরদর্শিতা, সততা ও একনিষ্ঠতার জন্য সারা বিশ্বে, গণমানুষের নেতা হিসেবে। আজকের বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার ফসল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close