নিজস্ব প্রতিবেদক
বাজার সয়লাব অবৈধ ফুড সাপ্লিমেন্টে
রাজধানীর ওষুধের দোকানগুলোতে ফুড সাপ্লিমেন্ট (ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন) নামে যা বেচাকেনা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই অবৈধ। অর্থাৎ দেশের বাজারে বিক্রির অনুমোদন না থাকার পরও এগুলোর বেচাকেনা হচ্ছে। আর জেনে বা না জেনেই চিকিৎসকরাও ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন এসব সাপ্লিমেন্টের নাম।
অনুসন্ধানে জানা গেল, বেশি টাকা লাভের আশায় এসব অনুমোদনহীন অবৈধ ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রির পেছনে কাজ করে বড় চক্রের ঘুষ-বাণিজ্য। কেননা অধিকাংশ ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রস্তুতকারী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিরই বাংলাদেশে অনুমোদন নেই। তারপরও এই কোম্পানিগুলো টাকার বিনিময়ে এসব পণ্য বিক্রি করাচ্ছে চিকিৎসক, ফার্মেসির মালিক এবং মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের দিয়ে।
রাজধানীর বিভিন্ন ওষুধের যেসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, রেভিকাল ট্যাবলেট, বনবিয়ান ট্যাবলেট, ওমেগা-৩, ট্যাবলেট ম্যাগবিয়ান, ক্রিয়েটিন পাউডার, ক্যাপসুল বায়োমেগা, ক্যাপসুল নোভাপ্লেক্স, রয়েল প্লাস, অভাসিড ক্যাপসুল, ভালিডো ক্যাপসুল, ল্যাকটোগিন ক্যাপসুল, উনেক্স ক্যাপসুল, ক্যাপসুল লেগুম-৭৫০, জয়েন্ট গ্লু, এম-লিনা ও ড্যানজোলার সোপ, ক্যাপসুল রেটিনেক্স, ক্যাসুল এইস পাওয়ার ও ট্যাবলেট জিসিএম প্লাস। এ ছাড়া বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন কেটসাম শ্যাম্পু, কেটোনীল সাবান। আর এসব সাপ্লিমেন্টের প্রস্তুতকারী এবং আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ম্যালভিকো ইন্টারন্যাশনাল, মিক্স মেডিক্যাল, এমএম ইন্টারন্যাশনাল, ইএম ইন্টারন্যাশনাল, জিএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক ট্রেডিং, বায়োলাইফ নিউট্রিশনালস, হেলথস্পান বিডি, মাল্টিপুল ট্রেডিং কোম্পানি, হেল অ্যান্ড হার্টি মেডিসিন লিমিটেডসহ বেশ কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, এদের কারোরই ফুড সাপ্লিমেন্ট, শ্যাম্পু বা সাবানের আমদানি, উৎপাদন বা বিপণনের অধিকার নেই।
রাজধানীর লাজফার্মা, তাজরিন ফার্মা, লিড ফার্মা, অনুরাগ ফার্মা, বাংলাদেশ ফার্মা, আবেদীন ফার্মা, ওয়াসী ফার্মা, আয়েশা ফার্মেসি, প্রিয়া ফার্মেসি, মির ফার্মা, রাসেল ফার্মা, মেডিকাস ফার্মা, গ্রিন লাইফ ফার্মেসি, আল-সামি ড্রাগ হাউস, বাংলাদেশ ফার্মা, রাজবাড়ী ড্রাগ হাউস, চৌধুরী ড্রাগ হাউস, নাজ ফার্মা, ভিআইপি ড্রাগ হাউস, গ্লোবাল ফার্মাসহ ছোট-বড় প্রায় সব ধরনের ফার্মেসিতেই দেখা মিলেছে ফুড সাপ্লিমেন্টের। আর দেখা পাওয়া যাবেই না কেন? চিকিৎসকরা রীতিমতো ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন এগুলোর নাম।
কয়েকটি কোম্পানির মালিকের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে বায়োলাইফ নিউট্রিশনালসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছি। কয়েক দফায় তাদের সঙ্গে বসেছি। আমরা চেষ্টা করছি অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই বাংলাদেশে পাঁচটা আমদানিকারক ফুড সাপ্লিমেন্ট থাকলে নিয়ম মেনে থাকুক। যাতে শত শত খারাপ ব্যবসায়ী এখানে ব্যবসা না করতে পারে।’
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইএম ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, যে ব্যবসা তিনি করেন সেটি তো ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। তারপরও ওষুধ বেচাকেনা করেন কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই তো ব্যবসা করছে। আমি কেন করব না? আমি খাব না? ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হবে, ফোনে কোনো কথা হবে না।’ এরপরই লাইনটি কেটে দেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বহির্বিভাগ এবং মেডিসিন বহির্বিভাগে এই প্রতিবেদক রোগী সেজে তিনজন চিকিৎসকের কাছে যান। যার মধ্যে দুজনই অবৈধ ফুড সাপ্লিমেন্ট এবং প্রসাধনী জাতীয় সামগ্রী ব্যবস্থাপত্রে লেখেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক সাব্বির আহম্মেদ ঢালী রোগী সেজে থাকা এই প্রতিবেদককে ‘বনবিয়ন’ (bonbion) নামে একটি ট্যাবলেট খেতে বলেন। তখন এই প্রতিবেদক চিকিৎসকে বলেন, ‘আপনি যে ওষুধটা দিলেন আমাকে এটা তো অবৈধ! এগুলোর তো ওষুধ প্রশাসন থেকে কোনো অনুমোদন নেই।’ জবাবে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘এগুলো তো বাজারে চলছে প্রতিনিয়ত। অনুমোদন না থাকলে চলছে কীভাবে? মানুষ তো খাচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের নৈতিকতার বিষয়টি মাথায় রেখে এখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। তবে মূল দায়িত্বটা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। ফার্মেসি বা কোম্পানিগুলোকে ঠিকমতো মনিটরিং করলে এগুলো বন্ধ হবে নতুবা হবে না।
পিডিএসও/হেলাল