নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ আগস্ট, ২০২০

টাকা পাচার ও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন কর্মরত বিদেশিরা

এ দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রকৃত তথ্য গোপন করে টাকা পাচার ও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন। অধিকাংশ বিদেশি কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বা পদমর্যাদার সঙ্গে ওয়ার্ক পারমিটে প্রদর্শিত বেতন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওয়ার্ক পারমিটে দেখানো পদবিতেও অসামঞ্জস্য রয়েছে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে বিদেশি কর্মীদের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের এ কৌশল বেরিয়ে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা। তারই অংশ হিসেবে বিদেশিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়েছে। আর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠিও দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিদেশি কর্মীরা এদেশে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকে। বেশির ভাগ চুক্তিতেই বলা থাকে আয়কর দেয়ার পর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বেতন হিসেবে দেয়ার কথা। কিন্তু বিদেশি কর্মীদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ কর থাকায় কর ফাঁকি দিতে তারা প্রকৃত বেতন গোপন করে যায়। তারা যতটুকু কর দেয় ততটুকুই বেতন হিসাবে প্রকাশ করে। বাকি টাকা চুক্তি অনুযায়ী হয়তো বিদেশি কোনো ব্যাংকে স্থানান্তর করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের নাগরিক কর্মরত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছেÑ ভারত, চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। তাদের মধ্যে ভারতের নাগরিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় বেশির ভাগ বিদেশি কাজ করেন।

সূত্র জানায়, অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি কর্মীদের বেতনের বড় একটি অংশ বিদেশে হস্তান্তর করা হয়। কারণ দেশে পুরো বেতন দেওয়া হলে নিয়মানুযায়ী শতকরা ৩০ ভাগ আয়কর দিতে হয়। তাতে বড় অংকের টাকা সরকারে ঘরে চলে যায়। সেজন্যই বিদেশি কর্মীরা বেতনের বড় অংশ নিজ দেশে বা অন্য কোনো দেশে গ্রহণের ক্ষেত্রেই বেশি আগ্রহী। কারণ দেশের বাইরে দেয়া বেতন বাবদ টাকার বৈধ কোনো রেকর্ড বাংলাদেশে থাকে না। এভাবেই পরিশোধিত টাকা নানা পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সরকার তা থেকে কোনো আয়কর পাচ্ছে না। ফলে দেশের সব দিক থেকেই লোকসান হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে কত বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছে তার সঠিক তথ্যও সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার কাছেই নেই। আয়কর বিভাগের রিটার্ন জমার তথ্যের সঙ্গে বিডা, বেপজা, এনজিও ব্যুরোর তথ্যের মিল নেই।

সূত্র আরো জানায়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত ওয়ার্ক পারমিটে বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতার বিষয়টি সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকছে না। বরং অনেক বিদেশি নিজ দেশ থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করে বলে জানা যায়। ওয়ার্ক পারমিটে তা উল্লেখ থাকে না। তাছাড়া অধিকাংশ বিদেশি কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও পদমর্যাদার আলোকে ওয়ার্ক পারমিটে প্রদর্শিত বেতন-ভাতা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওয়ার্ক পারমিটে প্রদর্শিত পদবি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি কর্মীর নিজ দেশে বেতন-ভাতা প্রদান এবং বাংলাদেশে কর্মকালীন বিদেশিরর ভরণ-পোষণের ব্যয়ভারের বিষয়টি ওয়ার্ক পারমিটে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।

এদিকে বিগত ২০১১ সালে ওয়ার্ক পারমিট স্ট্যান্ডিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদেশি নাগরিকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। যা বর্তমান শ্রম বাজারের বাস্তবতার নিরিখে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে বিদেশিদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিটের প্রদর্শিত বেতন কাঠামো বাস্তবে প্রাপ্ত বেতন কাঠামোর তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া বেশিরভাগ বিদেশি কর্মী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না খুলে বেতন-ভাতা গ্রহণ করে। ফলে তাদের বেতন কোথায় জমা হচ্ছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। অনেক বিদেশি নগদে বেতন গ্রহণ করে তা হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে পাঠান।

অন্যদিকে দেশে বিদেশি নাগরিকদের আগমন, অবস্থান ও কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও গাইডলাইন রয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেক বিদেশিই পর্যটক ভিসা ও অন-অ্যারাইভাল ভিসায় এদেশে এসে কাজ করে। আর প্রকৃত বেতনের এক-তৃতীয়াংশ তারা বৈধভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিয়ে থাকে। বাকি অংশ অবৈধভাবে নগদে গ্রহণ করে। অবৈধভাবে কর্মরত কর্মীদের শতভাগ বেতন নগদে অথবা দুবাই-সিঙ্গাপুরের মতো অন্য কোনো দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়া হয়। ওসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শুধু কর্মী নিজের হাত খরচ, আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে থাকে।

এ প্রসঙ্গে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে গোয়েন্দা সংস্থার চিঠিতে বলা হয়েছে- বিডা, বেজা, বেপজা এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ওয়ার্ক পারমিটের শর্ত হিসেবে বিদেশিদের বাংলাদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে বেতন গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সুস্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য বেতন কাঠামো নির্ধারণের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close