মিনহাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

দেশীয় শুঁটকির মান ও স্বাদের জন্য অণুজীবসমূহ শনাক্ত

দেশীয় পুঁটি মাছের প্রক্রিয়াজাতকৃত চ্যাপা-শুঁটকির বিশেষায়িত স্বাদ ও গন্ধের জন্য খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই শুঁটকি বানানোর প্রচলন থাকলেও মূলত ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নরসিংদীর উৎপাদিত চ্যাপা-শুঁটকির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর দেশে এ শুঁটকি ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেশীয় চ্যাপা-শুঁটকি বা সিদল শুঁটকি নিয়ে অত্যাধুনিক ডিএনএ প্রযুক্তি ‘মেটাজেনোমিকস’-এর গবেষণায় সাফল্য লাভ করেছেন।

দীর্ঘ এক বছর গবেষণার সিভাসুর প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী এবং ফিশিং ও পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহসিন সুলতানার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ এবং শুঁটকির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর সিভাসুর গবেষণাগারে এই নমুনাসমূহের রাসায়নিক ও ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়।

প্রচলিত পদ্ধতিতে পুঁটি মাছের (পুন্টিয়াস প্রজাতি) এর বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ভূ-গহ্বরে মাটির পাত্রে প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস দীর্ঘ গাঁজন পদ্ধতির মাধ্যমে এই বিশেষায়িত চ্যাপা-শুঁটকি প্রস্তুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অন্য অণুজীবসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘ গবেষণার পরে সিভাসুর গবেষক দল এই ব্যাকটেরিয়াসমূহ প্রকৃতি ও পরিমাণ এবং অঞ্চলভেদে স্বাদের তারতম্যের জন্য তাদের ভূমিকা উদ্ঘাটনের সফলতা লাভ করেছেন।

এই গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো অত্যাধুনিক এনজিএস সিক্যুয়েন্সিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে বায়ো-ইনফরমেটিক্স বা জৈব তথ্যবিজ্ঞানের মাধ্যমে ল্যাবরেটরিতে কোনরূপ কালচার ছাড়াই সংশ্লিষ্ট ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ। সিভাসুতে অবস্থিত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার সার্ভারে এ-সংক্রান্ত ডেটা এনালাইসিস করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণা সক্ষমতা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক।

গবেষণা সহকারী সিভাসুর এম এস এ শিক্ষার্থী মাহফুজুল আলম মিঠু জানান, চ্যাপা শুঁটকি প্রোটিন, স্থিতিশীল লিপিড ও খনিজ-লবণ এর একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং এটি সুষম অ্যামিনো অ্যাসিড বহন করে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং নানাবিধ রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় নিয়ে আরো গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তিনি আরো জানান, চ্যাপা-শুঁটকি উৎপাদনকারী হতে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এর পুষ্টিমান ধীরে ধীরে কমে যায়। সাধারণত এটি নির্ভর করে এর সংরক্ষণকালের ওপর। এছাড়াও পণ্যে গুণগত মানের কাঁচামাল ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। আমাদের দেশে কালের পরিক্রমায় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটেনি।

ফিশিং ও পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহসিন সুলতানা জানান, সব শুটকির নমুনা থেকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবসমূহের ডিএনএ তথা জিনের অনুসন্ধান করেন এবং অত্যাধুনিক জিন গবেষণা পদ্ধতি (ঘএঝ) ব্যবহার করে দেখতে পেয়েছেন এক অনন্য সাফল্য। তারা অনুজীবসমূহের প্রকৃতি ও প্রাচুর্য এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তুলনা করেন বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত নমুনাসমূহের মাঝে। তারা লক্ষ্য করা গেছে যে তথাকথিত পন্থায় প্রস্তুতকৃত শুঁটকিসমূহের মাঝে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর অণুজীব যা মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। কিন্তু গবেষণাগারে নিরাপদ পরিবেশে প্রস্তুতকৃত শুঁটকিতে মিলেছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া তথা অণুজীব যা মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী জানান, নানা সংস্কৃতির বিলাসী খাদ্যের জনপ্রিয়তায় বাঙালির নিজস্ব খাদ্য-বৈচিত্র্য যখন হারিয়ে যেতে বসেছে তখনো চ্যাপা-শুঁটকি আমাদের একান্ত নিজস্ব, আদি উৎপাদনকারীরা এর মান নিয়ন্ত্রণে সচেতন নয় ফলে এখনো তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব মৎস্যপণ্য উৎপাদন করে থাকে। এ ছাড়া এ মৎস্যপণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষই অক্ষর-জ্ঞানহীন ফলে মান নিয়ন্ত্রণ করে পণ্য উৎপাদনের গুরুত্বের বিষয়টিতে তারা এখনো সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি। বহুমাত্রিক গবেষণা, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়ন, সম্প্রসারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের দেশের এসব ঐতিহ্যবাহী মৎস্যপণ্যকে আরো উন্নত করে তোলা সম্ভব।

সিভাসুর মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আবছার খান জানান, সনাতন পদ্ধতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পুঁটি শুঁটকি ও চ্যাপা শুটকি তৈরি, পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা বেশির ভাগই নিরক্ষর হওয়ায় মৎস্যপণ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকে না ফলে পণ্যের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হয়। এই উন্নত পদ্ধতি অবলম্বন করলে অদূর ভবিষ্যতে চ্যাপা শুটকি রফতানি যোগ্য পণ্যে পরিণত হতে পারে যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন, ফিশিং ও পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান জনাব মো. ফয়সাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close