চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

যুদ্ধজয়ের গৌরবগাথা শুনে মুগ্ধ তরুণরা

মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের মুখে যুদ্ধজয়ের গৌরবগাথা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন তরুণরা। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আল বদরদের হত্যার ঘটনা শুনে হাততালি যেমন দিয়েছেন তারা, তেমনি আবার চোখ ছলছল করছিল হানাদারদের অত্যাচারের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে। কখনো আবার সহযোদ্ধা হারানোর ব্যথা, বাড়িঘরে পাকিস্তানি বাহিনীর গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেওয়া, স্বজনদের নির্মম আত্মদানের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারা। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে ‘বিজয়ের শেষ তিন দিন, কেমন ছিল চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব দৃশ্য দেখা যায়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) চট্টগ্রাম অফিস আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মনোযোগী শ্রোতা। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হারিছ বলেন, এ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রামে ৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। বিহারিরা যে বাঙালিকে কলোনিতে ধরে নিয়ে গেছে সে ফিরে আসেনি। ট্রেন দাঁড় করিয়ে বাঙালিদের বেছে বেছে হত্যা করে তারা। চট্টগ্রামের এসব ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা থাকলেও সুযোগ পাইনি। তিনি তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, তোমরা জঙ্গি থেকে সাবধান থেক। সঠিকভাবে লেখাপড়া করো।

মুক্তিযোদ্ধা-গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট, পতেঙ্গা, আমিন জুট মিল এলাকায় একসঙ্গে একই সময়ে অপারেশন হয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর বন্দরের অয়েল ডিপোতে বিমান আক্রমণ হয়। আমি ভেবেছিলাম পাক বাহিনীর বিমান! তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গেলে ছিলই না। আফসোস করতাম, হাতে যদি একটি রাইফেল থাকত গুলি করে বিমান ফেলে দিতাম।

তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জানত যেকোনো সময় একটি বুলেট বিঁধতে পারে। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে যুদ্ধে গেছি আমরা। জনগণও ভীত ছিল না। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিত। খাবার দিত। জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ৭৩ বছর বয়সে এখনো কাজ করে যাচ্ছি। সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। হাতি দেখে কেউ বলে মুলার মতো, কেউ বলে কুলার মতো। তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও অনেকে অনেককে চেনেন না। অনেক অপারেশন সম্পর্কে জানেন না। ২৩ মার্চ নৌবাহিনীর পোশাক পরে লাঠি হাতে মার্চপাস্ট করে সবাইকে লালদীঘিতে নিয়ে আসি। শেষ হয় চকবাজারে। ২৫ মার্চ স্টেশনের অনেক কুলির অবদান দেখেছি। হরিণা ক্যাম্পে ১৪ জন ছিলাম।

আবু সাঈদ সর্দার বলেন, জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হলেও, চট্টগ্রাম মুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। ১৪ থেকে ১৭ ডিসেম্বর আমি ছিলাম আগ্রাবাদ এলাকায় মৌলভী সৈয়দের বেইস ক্যাম্পে। তখন ওয়ারল্যাস ছিল না বলে খুব দূরের খবর পেতাম না। ১৪ ডিসেম্বর ৩০০ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই মুহুরীপাড়ার বিলে। হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস আসে। বাঙালি চালক ছিলেন। দুজন বিহারিকে পাই। তাদের ধরে মাটির দোতলায় আমাদের গোয়েন্দা সেলে নিয়ে যাই। তাদের তথ্য মতে একটি বাড়ি থেকে চারজন মেয়েকে উদ্ধার করি। কিছু অস্ত্রও পাই।

১৭ বার আমার বাড়িতে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী পাক সেনা নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। জল্লাদ জাফরুল্লা ও খোকা বার বার এ বাড়িতে এসেছিল। জল্লাদ খোকা আমার মায়ের নাকে রিভলবার ঢুকিয়ে বলেছিল, তোর পোয়া হডে (তোমার ছেলে কোথায়)? বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ বি এম খালেকুজ্জামান দাদুল বলেন, চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় লালদীঘি মাঠে। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল সেখানে। আমারও সুযোগ হয়েছিল অভিনয়ের।

১৪ ডিসেম্বর হাটহাজারী থেকে দেওয়ানবাজার চলে আসি। পুলিশ লাইন, কাজীর দেউড়িসহ আশপাশের বাজার থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে আসছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। আমরা খবর পেয়েছিলাম আবুল ফজলদের তালিকা করে মেরে ফেলা হবে। তখন মেয়ে, যুবকদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা-বাবারা। ত্রাসের রাজত্ব ছিল। সার্কিট হাউসের টর্চার সেলের চেয়ার দেখি। মূল্যবান ডকুমেন্ট পাই। যাতে লেখা ছিল কাদের কাদের মারতে হবে। আমি সেখানে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াই।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন দিন মিরসরাইয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাম্পে

অবস্থান করি। শুনছি প্রচুর মিলিটারি শহর অভিমুখে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও ভয় দুটোই ছিল। কারণ রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, সিভিল মানুষ সবার হাতে অস্ত্র ছিল না। রাতে কিছু বাড়ি লুট হয়। রাজাকার আতাউস সোবহানের জল্লাদখানায় করুণ অবস্থা দেখেছি। চারদিকে মানুষের মাথার খুলি, রক্তের দাগ।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরাট উপাখ্যান। চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন গেরিলা যোদ্ধারা। এর জন্য বেইস গড়ে তুলতে হয়। চট্টগ্রাম শহরে ১৪ ডিসেম্বর থেকে আতঙ্ক ছিল। আবার ভেতরে ভেতরে উল্লাসও ছিল। বোমারুবিমানে করে মুক্তিযোদ্ধারা বোমা বর্ষণ করেছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা ভবনের ছাদে উঠে হাততালি দিত। জনগণের সাহস বেড়েছিল। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল বিজয় সন্নিকটে। আশঙ্কার কারণ রাজাকার আল বদররা সুশীল সমাজের তালিকা করেছিল মেরে ফেলার জন্য। ১৫ ডিসেম্বর শুনতে পাই কুমিরা যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পিছু হটেছে। কুমিরা ফৌজদারহাটে প্রাণপণ যুদ্ধ হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল পাক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়লে পরাজিত করা কঠিন হবে।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, চান্দগাঁওয়ের ইউনুস রাজাকার রাইফেল নিয়ে ঘুরত আর বলত হট যাও হট যাও। এক দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা মিস ফায়ার দিলে ইউনুস রাজাকার রাইফেল ফেলে দৌড় দেন।

নগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে আমার মায়ের কথা বলতে হয়। তার চার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। অথচ আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। আফসোস মীর কাশিম আলীকে অল্পের জন্য ধরতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক মনজুরুল আলম মঞ্জু বলেন, আমি পদকের জন্য যুদ্ধ করিনি। দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে যাই। পতাকার জন্য যুদ্ধ করি। অনেকের নামে স্কয়ার, সড়ক হচ্ছে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নামে স্কয়ার করার জন্য মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানাই। কারণ মিত্র বাহিনীর সহায়তা, অবদান ভোলার নয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বাসসের চট্টগ্রাম প্রধান কলিম সরওয়ার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close