চট্টগ্রাম ব্যুরো
চসিকের কৌশলী উদ্যোগ
বিনিয়োগ ছাড়াই সবুজে সেজেছে বন্দরনগরী
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কৌশলী উদ্যোগে বিনিয়োগ ছাড়াই সবুজে সেজে উঠছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। নগরের প্রায় প্রতিটি স্পট সেজে উঠছে সবুজে সবুজে। নান্দনিকতায় ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরো চট্টগ্রাম। তবে এসব নিয়ে চসিকের নিজস্ব আর্থিক কোনো বিনিয়োগ নেই। উল্টো এসব সৌন্দর্য বর্ধন কাজ থেকে চসিকের রাজস্ব আয় হচ্ছে। ‘আউটসোর্সিং’ এর মাধ্যমে চসিক সৌন্দর্য বর্ধনের এ উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ নিজেদের কোম্পানির ব্র্যান্ডিং করতে নিজেদের খরচে সিটি করপোরেশনের সড়কদ্বীপ, গোলচত্বর, ফুটপাত নান্দনিক করে তুলছে। শুধু নান্দনিক করে গড়ে তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তাদের এ কার্যক্রম। গড়ে তোলা সড়কদ্বীপ, গোলচত্বর, ফুটপাত, বাগান সবই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্রুপের। তবে বিশিষ্টজনরা বলছেন, নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাব হলে সৌন্দর্য বর্ধনের চেয়ে বাণিজ্যই প্রাধান্য পাবে।
জানা গেছে, গত ৪ জুলাই সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ‘ইনোভেশন শোকেসিং উদ্ভাবনী কর্মশালার’ আয়োজন করা হয়। এতে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন, চারটি ওয়াসা এবং চারটি পৌরসভা অংশগ্রহণ করে। যেখানে চসিক প্রথম স্থান অধিকার করে। যার পেছনে অন্যতম উদ্ভাবন ছিল, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নগরীর গোলচত্বরে সৌন্দর্য বর্ধন, সড়কদ্বীপ, স্কুল-কলেজের সীমানা প্রাচীর ও পরিত্যক্ত স্থানে ম্যুরাল ভাস্কর্য, ঝর্ণা/ফোয়ারা, বৃক্ষ রোপণ ও বাগান করার মাধ্যমে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। গত বছরের চসিক এমন কৌশলী উদ্যোগে নগরীকে নান্দনিক করার উদ্যোগ নেয়। তখন থেকে নগরীর মূল সড়কে ৩০টিরও বেশি ডাস্টবিন রূপ নিয়েছে নান্দনিক সবুজ বাগানে।
নগরীর চটেশ্বরী মোড়ের ত্রিভুজাকার চত্বরটির নাম ‘জহুর-মান্নান’। এই চত্বরে আগে ছিল ডাস্টবিন। সারা দিন আশপাশ থেকে আসা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমত চত্বরটিতে। দুর্গন্ধে নাক চেপে হাঁটতে হতো পথচারীদের। সে জায়গায় এখন আর ডাস্টবিন নেই। আছে সবুজের সঙ্গে রয়েছে নান্দনিক স্থাপত্য। যেটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম এ মান্নানকে প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়াও নগরীর জিপিও বিপরীত পাশে আলকরণের মুখে ছিল বড় আকারের ডাস্টবিন। যেখানে ময়লার দুর্গন্ধে মানুষের হাঁটা ছিল দায়, সেখানে মানুষ এখন দাঁড়িয়ে ছবি তুলে। ধারণ করে রাখতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে। নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার ডবলমুরিং থানার সামনে সরেজমিনে দেখা যায়, ফুটপাতে পাশের দেওয়ালটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা ইতিহাসের চাপ। সবুজে আঁকড়ে ধরেছে ফুটপাতটিকে। সবমিলিয়ে নগরবাসীর ব্যস্ততাকে ভুলিয়ে দেওয়ার মতো নান্দনিকতা ছুঁয়েছে ফুটপাতজুড়ে। অন্যদিকে এয়ারপোর্ট রোডের নান্দনিকতা সবজনে প্রশংসিত হয়ে আসছে শুরুর থেকেই।
করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন সড়কের আইল্যান্ড, ফুটপাত আধুনিকায়ন ও সবুজায়নে সিটি করপোরেশন আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে চুক্তি করে। যেখানে দ্বিতীয়পক্ষ নিজের খরচে সব স্থাপত্য স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তবে এক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত ব্রান্ডিং করার সুযোগ পাবে। নগরীতে বিলবোর্ড উচ্ছেদ হওয়ায় ব্রান্ডিং এমন সুযোগকে লুফে নিচ্ছেন বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ।
এমন উদ্যোগের বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, গোটা চট্টগ্রামকে আধুনিক ও সবুজ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু হয়েছে। নগরীতে ব্যাপকভাবে কাজ চলছে। প্রাচ্যের রানি হিসেবে একসময় খ্যাত এ নগরের ফুটপাত, আইল্যান্ডে যত্রতত্র বিলবোর্ড স্থাপনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মেয়র নির্বাচিত হবার পর থেকে প্রাচ্যেও রানি হিসেবে খ্যাত এ নগরের খ্যাতি ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করি। আমরা ‘আউটসোসিং’ এর মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের সুযোগ দিই। এতে নগরও নান্দনিক হয়ে উঠছে আর তাদের খরচে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই। তখন নগরীর বেশির ভাগ ডাস্টবিন ছিল মূল সড়কের পর। মানুষ দুর্গন্ধে হাঁটতে পারত না। সেখান থেকে প্রায় ৮০০ ডাস্টবিন সরিয়েছি। তা ছাড়াও বড় বড় ডাস্টবিনের জায়গায় এখন সবুজ বাগান। এই শহরকে আমি ডাস্টবিনগুলোর মতোই পরিবর্তন করে দিতে চাই। এসব নগরবাসীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে গত বছর জানুয়ারিতে সর্বপ্রথম ইস্পাহানী মোড় হতে মিড আইল্যান্ড ও রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাতসহ টাইগারপাস গোলচত্বর ও পূর্বপাশের পুলিশ কন্ট্রোলরুম পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। এরপর থেকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের উভয়পাশে ফুটপাত ও মিড আইল্যান্ডে সৌন্দর্য বর্ধন ও সবুজায়ন, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ৮৮নং সংলগ্ন চকবাজার থেকে মুরাদপুর সড়কের পাশে নালার ওপর সø্যাপ এপ্রোচ নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধন, জিপিও থেকে নিউমার্কেট মোড় হয়ে পুরোনো রেল স্টেশন পর্যন্ত এবং নিউমার্কেট মোড় থেকে শাহ আমানত মার্কেট পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধন ও গোলচত্বরগুলো সবুজায়ন, আগ্রাবাদ বাদামতল মোড় থেকে বারিকবিল্ডিং গোলচত্বর পর্যন্ত ফুটপাত, মিডআইল্যান্ড ও গোলচত্বরে সৌন্দর্যবর্ধন, সিটি গেট থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধন, প্রবর্তক মোড়ে আইয়ুব বাচ্চু চত্বরসহ গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধন, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বাদামতলী মোড় থেকে আগ্রাবাদ জনতা ব্যাংকের মোড় পর্যন্ত, ষোলশহর ২নং গেট মোড় থেকে জিইসি মোড় হয়ে লালখান বাজার ইস্পাহানী মোড় পর্যন্ত, পাঁচলাইশ মক্কী মসজিদ থেকে ফিরিঙ্গিবাজারসহ নতুনব্রিজ পর্যন্ত, বাগমনিরাম এলাকার ওয়েলফুডের সামনে থেকে গোল পাহাড় মোড় পর্যন্ত, ২নং গেটের বিপ্লব উদ্যান ও চারপাশের ফুটপাত, কাস্টমস মোড় থেকে পতেঙ্গা মোড় পর্যন্ত, চকবাজারের অলি খাঁ মোড় থেকে মুরাদপুর, চসিকের অধীনস্থ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালে পানির এটিএম বুথ স্থাপন।
এ ছাড়া, হোটেল আগ্রাবাদের সামনে এইচআরসি ভবনের পূর্ব এবং উত্তর পাশের ফুটপাত আধুনিকায়ন ও সবুজায়ন, ফয়েজ লেক এপ্রোচ রোডের মিডআইল্যান্ড, চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামের উত্তর ও পূর্ব পাশের ফুটপাত নান্দনিক করণ ও নাগরিক সুবিধা উন্নয়ন, চট্টেশ্বরী মোড়ে ত্রিভুজাকার আইল্যান্ড, বায়েজিদ বোস্তামিস্থ তারা গেট-ব্যাটালিয়ন মোড় থেকে ক্লিপটন মোড় পর্যন্ত, নাগরিক সেবা উন্নয়নের জন্য ‘মেট্রো প্রভাতি’ স্পেশাল বাস কাউন্টারের জন্য অস্থায়ী বক্স কান্টার স্থাপন, ডিটি রোড় দেওয়ানহাট মোড় থেকে কাঁচাবাজার মোড় পর্যন্ত, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে লালদীঘির উত্তর কোণা পর্যন্ত, গোলপাহাড় মোড় থেকে এমএম আলী রোড, কাজীর দেউড়ি আলমাস সিনেমা মোড় থেকে ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়ের সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে থেকে ফুটপাত, ভঙ্গিশাহ মাজার চত্বর থেকে কদমতলী নিচের মোড় পর্যন্ত, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের কার্যলয় থেকে প্রবর্তক মিয়াবিবি শো-রুম পর্যন্ত, ২নং গেটের মোড়ের পূর্ব পাশ, বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের পশ্চিমে, চকবাজার প্যারেডে কর্নারের উত্তর-পশ্চিম পর্যন্ত, জামালখানে পিডিবি অফিসার্স কোয়ার্টার সংলগ্ন ফুটপাতে গার্ডেনিং, লাইটিং, সিটিং , শপ ও লাইভ ফিশ একুরিয়াম নির্মাণ, শুল্কবহর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের পূর্বে গোলচত্বর, বহদ্দারহাট গোলচত্বর, বহদ্দারহাট এখাচুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়েল সামনে সৌন্দর্য বর্ধন, ঈদগাহ কাঁচা রাস্তা থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত মিড আইল্যান্ড, হাউজিং মোড় থেকে একে খান মোড় পর্যন্ত, ২নং গেট মোড় থেকে শেখ ফরিদ মার্কেটের কর্নার থেকে এসএ পরিবহনের কর্নার পর্যন্ত ফুটপাত উন্নয়ন ও সবুজায়ন করা হয়েছে। এসব ছাড়াও আরো ১০টির মতো সড়কে সবুজায়ন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে চসিকের পরিকল্পনা বিভাগ।
"