তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট

জড়িতদের ধরতে সক্রিয় প্রশাসন

মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছে স্থানীয় কিছু মানুষ এবং রোহিঙ্গা দালালদের সিন্ডিকেট। সফটওয়্যারের সঙ্গে ইন্টারভিউ মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার কাজ করছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর। এই সিন্ডিকেটটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), নাগরিকত্ব সনদ, জন্ম সনদ এবং পরিচিত মাধ্যম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে ঘুষ দিয়ে পুলিশি যাচাই-বাছাইকরণের কাজও সম্পন্ন করে নেয়। এদের গ্রেফতার করতে মাঠে নেমেছে প্রশাসন।

পুলিশ ও পাসপোর্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে। পাসপোর্টের জন্য করা আবেদনে রোহিঙ্গারা ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে। সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকা থেকে ভুয়া পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক করেছে পুলিশ। আটকরা হলো মো. ইউসুফ, মো. মুসা ও মোহাম্মদ আজিজ প্রকাশ আইয়াজ। তারা তিনজনই মিয়ানমারের মংডু থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসে এবং বর্তমানে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবারসহ বসবাস করছে।

পুলিশ বলছে, এই তিনজন ২০১৭ সালে পরিবারসহ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে তাদের আটক করা হয়। এদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পাসপোর্ট পেয়ে যায়। অন্যজন এ বছরের জানুয়ারিতে পাসপোর্ট পায়। এর আগের দিন ৫ সেপ্টেম্বর পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করাতে আসা এক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করেছিল চট্টগ্রামের বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস। আটক রোহিঙ্গা যুবকের নাম শফিউল হাই। পরে তাকে নগরীর ডাবলমুরিং থানায় সোপর্দ করা হয়। একই দিন রাতে কাট্টলি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের বার্মা কলোনি এলাকা থেকে আরো চার রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। এদের মধ্যে একজন নারীর কাছে বাংলাদেশের এনআইডি কার্ড পাওয়া যায়।

এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট পাওয়ার বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চট্টগ্রামে আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় এবং পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গিয়ে এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদকের টিম। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত জালিয়াত চক্রের বিষয়ে শিগগিরই বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।

গতকাল রোববার দুপুরে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এর একটি এনফোর্সমেন্ট টিম নগরীর লাভ লেইনে আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে যায়। টিমের সদস্যরা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খানের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া-সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব তথ্যের মধ্যে আছে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদসহ আরো কী কী দলিল জমা দিতে হয়, সার্ভারে জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোড দেওয়ার পদ্ধতি, এ পর্যন্ত কতজন জাতীয় পরিচয়পত্রপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা শনাক্ত হয়েছে ইত্যাদি।

দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্য সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ জানান, নির্বাচন কর্মকর্তারা তথ্য দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৬ জন রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছেন, যারা তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সার্ভারে তাদের তথ্য সংরক্ষিত আছে। এই ৪৬ জনের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা ডাকাতও আছে, যে কয়েক দিন আগে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ওনারা বলছে, এসব রোহিঙ্গার তথ্য ঢাকা থেকে সার্ভারে সংযুক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কিছুই আপলোড হয়নি।

দুদকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন জানান, জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ভোটার তালিকার কাজে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি ল্যাপটপের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ২০১৫ সালের পর থেকে। এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এসব ল্যাপটপের তথ্য নির্বাচন অফিস কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানেন না। রোহিঙ্গারা ভোটার হয়ে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে পাসপোর্ট করতে যাচ্ছে। এমন ৫৪ জনের তথ্য চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিস থেকে দুদককে দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্টের এক কর্মকর্তা নাম না জানার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড, জন্ম সনদ ও নাগরিকত্ব সনদ দেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই দায়ী। তারা টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় সনদ দিচ্ছেন।

অনুসন্ধান বলছে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ঘিরে কিছু দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রথমে ওই দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই রোহিঙ্গা দালাল তাদের কক্সবাজারের চকরিয়ার অপর এক বাংলাদেশি দালালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে চকরিয়ার ওই দালাল চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট দালালদের কাছে পাঠায়। তারা পাসপোর্ট অফিসের কথিত দালালদের দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে এবং আবেদনের মাধ্যমে তারা পাসপোর্ট পেয়ে যায়।

অনুসন্ধান আরো বলছে, অনেকের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনসহ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবানের লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দুটির শত শত রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছে। তারা ক্যাম্পেও যাতায়াত করছে বলে জানা গেছে। এমনকি মিয়ানমার থাকতেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টের মালিক হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টের পর নতুন করে অনুপ্রবেশের পর দালালদের মাধ্যমে এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। তারা চেষ্টা করছে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার। এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রবাসী স্বজনরা ও বাংলাদেশি অভিবাসী দালালরা। গত কয়েক বছরে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয়েছে কয়েকশ রোহিঙ্গা।

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, তুমরু স্থলসীমান্ত দিয়ে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সপরিবারে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় কামাল উদ্দিন। তিন মাসের মাথায় তার ছেলে নুরুল আমিনকে ওমরা ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নুরুল আমিন মিয়ানমার থাকতেই বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (নং ১৯৮৭১৯১৩১৫৭০৩৩৩৯০) বানিয়ে নেয়। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার তারাসাইল কুমারদোঘা ঠিকানায় দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট (নং বিবি ০২২৪৮৯৯) তৈরি করে নেয় সে। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর নুরুল আমিন ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি দেয়। তার পরিবার বালুখালী ৯নং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। একইভাবে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ১নং ক্যাম্পের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা মরজিনা আক্তারের স্বামী মৌলভী আবু বকর ছিদ্দিক এনআইডি বানিয়ে নিয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাকলিয়া থানার কালামিয়া বাজার এলাকার ঠিকানায় বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (নং ১৯৮২১৫৯১০১৮০০০১১৩) বানিয়ে যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে। উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী মেগা আশ্রয় শিবিরের ২০নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আবছার। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ২৭৮ বাইশারী মৌজার দক্ষিণ বাইশারী এলাকার ঠিকানায় বাংলাদেশি এনআইডি (নং ০৩১৭৩১৯৩৭৫১৪৯) বানিয়ে নিয়েছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান জানান, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। সেজন্য তারা তথ্য নিতে এসেছিল। আমরা সব তথ্য দিয়েছি। আমাদের তদন্ত কমিটিও যে কাজ করছে, সেটা উনারা জেনেছে। তবে কোনো নথিপত্র উনারা নিয়ে যায়নি। এটা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হবে বলে ওনারা জানিয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close