এস এইচ এম তরিকুল/বিশেষ প্রতিবেদক, রাজশাহী

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

রাজশাহী স্টেশনের চিত্র

রেল টিকিটের জন্য হাহাকার হিসাবের খাতায় ‘অবিক্রীত’

রাজশাহীতে রেলের টিকিট যেন সোনার হরিণ। বহু আগে থেকে বুকিং দিতে হয় আর দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মেলে ‘সোনার হরিণের’। শুধু সাধারণ মানের ‘শোভন চেয়ার’ নয়, এসি চেয়ার বা এসি বাথ টিকিট পাওয়ার জন্যও রীতিমতো তদবির করতে হয়। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালী ছাড়া এ টিকিট মেলে না। অথচ অবাক করার মতো ঘটনা হলো রাজশাহী রেলস্টেশনে সরকারি হিসাবে অনেক অবিক্রীত টিকিট দেখানো হচ্ছে।

জানা গেছে, কাউন্টারে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পাওয়া যায় না শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বগির টিকিট। এ নিয়ে প্রায়ই রেলস্টেশনে হট্টোগোল হয়, টিকিট কালোবাজারেও বিক্রি হয়, এই অভিযোগে গ্রেফতারের ঘটনাও রয়েছে অনেক।

ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচল করে এখন চারটি আন্তনগর ট্রেন। এই চারটি ট্রেনের এসি চেয়ার বা এসি বাথ/সিটের টিকিট না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ানো টিকিটপ্রত্যাশীরা। ভিআইপি ও প্রভাবশালী ছাড়া সাধারণের কাছে পৌঁছায় না এসব টিকিট। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মাস শেষে যখন পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কাছে টিকিট বিক্রির হিসাব গিয়ে জমা পড়ছে, সেখানে এই এসির টিকিটই আসন সংখ্যার চেয়ে কম বিক্রি (অবিক্রীত) হচ্ছে বলে হিসাব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, শোভন চেয়ারের টিকিট প্রতি মাসেই আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে বলেও হিসাব জমা পড়ছে।

অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, ‘এসির টিকিট অবিক্রীত তো পরের কথা, তদবির ছাড়া এ টিকিট মেলা দায়।’

তবে মাস শেষে জমা হওয়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হিসেবে এসির টিকিটে কেন এই গরমিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ বলেন, ‘এসির সব টিকিট রাজশাহী স্টেশনের জন্য বরাদ্দ থাকে না। অনেক টিকিটই থাকে বঙ্গবন্ধু বা চাটমোহর স্টেশনের জন্য। আর এসির স্ট্যান্ডিং টিকিট সেল করা যায় না। ফলে সেখানে টিকিট অবিক্রীত থাকে। এ কারণে মাস শেষে অবিক্রীত টিকিটের হিসাবটা উঠে আসে।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে প্রতিদিন যে সিল্কসিটি আন্তনগর ট্রেনটি চলাচল করে, সেটির আসন সংখ্যা ১৪৪টি। সে হিসাবে মাসে ২৬ দিন চলাচল করলে আসন সংখ্যা বা টিকিট গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৭টি। কিন্তু নথিজাতকৃত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গত জুন মাসে এই টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭১টি। একই ট্রেনের এসি চেয়ারের সংখ্যা রয়েছে ১৫৬টি। সেটি মাস শেষে আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৫৬টি। কিন্তু ৩ হাজার ২২টি টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে হিসাব দেওয়া হয়।

আবার শোভন চেয়ারের সংখ্যা হলো প্রতিদিন একই ট্রেনে ৮৩০টি। যেটি মাস শেষে ২১ হাজার ৫৮০টি। কিন্তু জুন মাসে ৩৮ হাজার ৫১৭টি টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে হিসাব দেওয়া হয়। এসব টিকিট বিক্রি করে জুন মাসে আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৫ টাকা।

আবার সিল্কসিটি ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা ট্রেনে জুন মাসে এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭১টি, এসি চেয়ারের ৩ হাজার ৮৫৪টি এবং শোভন চেয়ারের টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার ১৩৪টি। একই মাসে পদ্মা ট্রেনের এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি দেখানো হয় ২ হাজার ৫৯২টি, এসি চেয়ার ২ হাজার ৮২৩টি এবং শোভন চেয়ার বিক্রি হয় ৩৩ হাজার ২২টি। ওই মাসে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া পদ্মা ট্রেনের এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি দেখানো হয় ২ হাজার ১৫৩টি, এসি চেয়ার ৪ হাজার ৫৩৫টি এবং শোভন চেয়ার বিক্রি হয় ৩০ হাজার ৩৫৭টি।

অন্যদিকে বিরতিহীন বনলতা ট্রেনের জুন মাসে ৪ হাজার ১৬০টি আসনের বিপরীতে টিকিট বিক্রি হয় ৪ হাজার ২৮৭টি। শুধু এই ট্রেনের এসি টিকিটই বিক্রি বেশি দেখানো হয়েছে। এভাবে প্রতি মাসেই সিল্কসিটি, পদ্মা ও ধূমকেতু ট্রেনের বিপুল পরিমাণ এসির টিকিট অবিক্রীত থাকছে বলেও অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা থাকেন ঢাকায়। এসব কর্মকর্তা মাসে কমপক্ষে ৭-৮ বার বা তারও বেশি ঢাকায় যাতায়াত করেন। এই কর্মকর্তাদের জন্য এসি সিট/বাথ অথবা এসি চেয়ার টিকিট রাখতে হয়। ফলে বেশ কিছুসংখ্যক টিকিট অবিক্রীত থেকে যায় প্রতি মাসে প্রতিটি ট্রেনেই।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দাবি, রেলস্টাফদের চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের খামখেয়ালিপনায় মাস শেষে এসির টিকিট অবিক্রীত থাকছে। এসব নেতা নিয়মিত যাতায়াত করেন। ট্রেন ছাড়ার পূর্বমুহূর্তে অনেক সময়ই জানানো হয়, তারা (নেতা বা আমলা) সেই ট্রেনে যেতে পারছেন না।’

সার্বিক বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমি যে কয়দিন আছি, ট্রেনের যাত্রীসেবা নিয়ে কাউকে কোনো অনিয়ম করতে দেওয়া হবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close