মারুফ আহমেদ, কুমিল্লা

  ২১ মে, ২০১৯

অভিভাবকদের অভিমত এখনই পদক্ষেপ দরকার

কুমিল্লায় বেপরোয়া কিশোর অপরাধ

কুমিল্লা মহানগরীতে বখে যাওয়া স্কুলগামী কিশোর গ্যাংদের তৎপরতা বহু পুরোনো। এক সময় লাঠিসোটা নিয়ে মারামারি করত, পরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিত। আর এখন এসব কিশোর গ্যাং অনিয়ন্ত্রিত, হাতে হাতে চলে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র।

এক মাসে নগরীর ঠাকুরপাড়া ও মোগলটুলীতে যে দুটি কিশোর হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে দুটিতেই জড়িত ছিল ‘ঈগল গ্যাং’ নামে এক কিশোর গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়াও রয়েছে আরো কমপক্ষে ৮/১০টি গ্যাং। বিভিন্ন স্কুল কলেজ, বিপণিবিতান, গার্লস স্কুলসহ নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে রয়েছে এসব গ্যাংয়ের পদচারণা। আর এরা নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের হাতে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে কথা বলার সাহস পায় না।

সাধারণ অভিভাবকরা এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ দমন শাখার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সবশেষ হওয়া ১৩ মে রাতের হত্যাকা-ে জড়িত অনিক (১৮), জাহিদ (১৭) ও খায়রুলকে (১৭) ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করে।

কুমিল্লায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, সম্ভবত ২০০০ সালে নগরীতে ‘আতকা’ নামেই কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। এরপর একে একে জন্ম নেয় সিআর সেভেন, ব্ল্যাক ড্রাগন, রেক্স, ঈগল গ্যাং, ডিডব্লিউআর, ঈগল, হেপেন গ্রুপ, ভিল্লা গ্রুপ, সিভিসি, এলআর, আরজিএস, এক্স, এলআরএন, মডার্ন, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, বস, এক্স সি এম এইচ এস। প্রতিদিনই বাড়ছে তাদের সদস্য সংখ্যা, সংযোজিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

জানা গেছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেওয়া, প্রেম, উঠতি কিশোরদের ইন্টারনেট, মাদক সেবনের বাড়তি আয় বা ফ্রি মাদক সেবন, ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন এলাকায় বড় ভাইদের অপরাধে সহযোগী হতে গিয়ে এসব গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত হয় কিশোররা।

নগরীর একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্কুল ছুটির পর নওয়াব ফয়জুন্নেছা, ফরিদা বিদ্যায়তন, আওয়ার লেডি অব ফাতিমা গার্লস স্কুলের সামনে নম্বরবিহীন হোন্ডা, নগরীর প্রধান প্রধান বিপণিবিতান খন্দকার হক টাওয়ার, ছাত্তার খান প্লাজা, ইস্টার্ন ইয়াকুব প্লাজা, তালপুকুর পাড় এলাকা, ধর্মসাগরের দক্ষিণ পাড়ের প্রবেশপথ, কুমিল্লা টাওয়ারের উত্তরপাশের গলি, ঝাউতলা গ্রামীণফোন অফিস, মোগলটুলী হোটেল আনসারিয়ার আশপাশ এলাকায় বখে যাওয়া স্কুল-কলেজের অনেকেই আড্ডায় মেতে উঠে। সন্ধ্যা বা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব তরুণ কিশোরদের আড্ডা যেন আরো জমে ওঠে। তাদের হাতে হাতে দামি মোবাইল আর সিগারেট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৩ মে রাতে নগরীর মোগলটুলী এলাকায় ‘ঈগল গ্যাং’ এর সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন ঝাউতলা এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে আজমাইন আদিল (১৬)। গত ২১ এপ্রিল শবেবরাতের রাতে খুন হয় কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার দুর্গাপুর উত্তর ইউনিয়নের ঝাগুড়ঝুলি বিষ্ণুপুর এলাকার সিঙ্গাপুর প্রবাসী আবুল কালাম আজাদের ছেলে মডার্ন হাইস্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মুমতাহিন হাসান মিরন। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকা থেকে পুলিশ নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকায় বসবাসকারী আমিন নামের ৭ম শ্রেণির স্কুলছাত্রকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও গত ২১ এপ্রিল দুই স্কুল ছাত্রের হাতে নগরীর নুরপুর এলাকায় শাহজাহান নামের এক বাইকচালক চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত হন। ১৬ এপ্রিল কুমিল্লা জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী মারুফ ছুরিকাঘাত হয় নগরীর কালেক্টরেট স্কুলের এক ছাত্রের হাতে। এমনিভাবে গত ১০ মার্চ নগরীর দিশাবন্দ এলাকায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে সাজ্জাতুল ইসলাম (১৬) নামের এক কিশোরকে চর্থা এলাকায় ইউসুফ নামের এক কিশোর স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালের ১১ জুলাই রাতে নগরীর পুলিশ লাইন এলাকার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে অজিতগুহ কলেজের শিক্ষার্র্থী অন্তু নামের এক কিশোরকে খুন করা হয়। ২০১৭ সালে নগরীর নজরুল এভিনিউ সড়কে শাহজাদা ইসলাম নামে বিবিএ শিক্ষার্থীকে কিশোর অপরাধীরা কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাদুরতলা এলাকার এক অভিভাবক জানান, কিশোর অপরাধের জন্য অভিভাবকদের গাফিলতি এড়ানোর সুযোগ নেই। এসব গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, কিশোরদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নীতিনৈতিকতার চর্চা হওয়া দরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি করলেই এসব অপরাধ কমে যাবে। রাজনৈতিক নেতারা মঞ্চে যা বলেন তা বাস্তবে করে দেখালেই এসব শিশু কিশোররা ভালো হয়ে যাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কিশোর অপরাধীর বাবা বলেন, আমার সন্তান পড়ালেখার ফাঁকে কখন যে এসব অপরাধে জড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। আমরা হতাশ। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন করে ভালো খরচে তাদের ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি, এখন এই যদি হয় অবস্থা আমার মতো অভিবাবকদের মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও আইন বিভাগের প্রভাষক সাইদা তালুকদার রাহি বলেন, কিশোরদের এই সময়টাতে শারীরিক এবং মানষিক পরিবর্তন হয়। বাবা-মা যখন তাদের সন্তানদের সময় দেয় না, কিশোররা অনেক কিছু শেয়ার করার জন্য যায় বন্ধুবান্ধব বা তাদের দলের কাছে। বেশির ভাগই তারা সঠিক পরামর্শ না দিয়ে বরং পথভ্রষ্ট করে। কিশোরদের শাস্তি দেওয়া বা কৃমিনাল হিসেবে গণ্য করা কোনো সমাধান নয়। এর জন্য প্রয়োজন পারিবারিক কাউন্সিলিং, পরিবার সমাজের মধ্যে সঠিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কুমিল্লা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, কিশোররা যেন আর কোনো অপরাধ করতে না পারে, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই আটক করে অভিভাবকদের ডেকে তাদের সন্তানদের সতর্ক করে দিয়েছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close