ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিনই নামছে নতুন মোটরসাইকেল। তবে দুই বছরে এ হার বেড়েছে অনেক। মূলত মুঠোফোনের অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা চালুর পর থেকে ঢাকায় লাফিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং যাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি চালকের অদক্ষতা, আইন না মানা, দ্রুত যাওয়ার প্রবণতা, নিরাপত্তা উপকরণ না নিয়ে চালানো, রাজধানীর সড়ক সম্পর্কে ধারণা না থাকাকেও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

২০১৬ সালে ঢাকায় রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে আসে উবার। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে এ সেবার সুযোগ করে দিলেও পরে মোটরসাইকেলও যুক্ত করে। একই সময়ে একে একে আসে পাঠাও, স্যাম, বাহন ও সহজ। দুই বছরে ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল বাড়ার চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যে।

প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে যেখানে ৫৩ হাজার ৭৩৮টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত হয় ৭৫ হাজার ২৫১টি। আর এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩৩২টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয়েছে।

এ হিসেবে, ২০১৭ সালে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০৬টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। আর এ বছরের প্রথম আট মাসে প্রতিদিন গড়ে ২৬৭টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। তবে রাইড শেয়ারিংয়ে যেসব মোটরসাইকেল চলে, তার একটা বড় অংশ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার নম্বরপ্লেটধারী। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকায় ৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৫৩ জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হন। এ বছরের আট মাসেই (জানুয়ারি-আগস্ট) সেই সংখ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এ সময়ে ঢাকায় ৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের মৃত্যু এবং ৩৭ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের অনেকেই রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালক অথবা যাত্রী ছিলেন।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর খিলক্ষেতে দুর্ঘটনায় মারা যান লাফিজুর রহমান নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী। ৩ সেপ্টেম্বর রাতে মতিঝিল এলাকায় রিপন শিকদার এবং জানে আলম গাজী নামে দুজন নিহত হন। এরও আগে ২০ আগস্ট মোহাম্মদপুরে ট্রাকের ধাক্কায় সোহেল পারভেজ, ৬ জুলাই বিমানবন্দর গোলচত্বরের কাছে নাজমুল হাসান এবং ৬ মার্চ তেজগাঁওয়ের আড়ং চেকপোস্টে কাজী মারুফ হাসান নামে আরোহী নিহত হন।

দুর্ঘটনার জন্য চালকদের অদক্ষতা এবং নিরাপত্তা জ্ঞানের অভাবকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বুয়েটের এআরআইয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ।

ছয় মাস ধরে রাইড শেয়ার করে আসা মফিজুল হক বলেন, ‘আগে প্রাইভেট কার চালালেও মোটরসাইকেল পারতেন না। ছয় মাস আগে তিনি মোটর সাইকেল কিনছেন। আরেকজন চালাইয়া বাসায় আনছে। হেইদিনই এক ঘণ্টা চালাইয়া শিখছি। এরপর থেইকা রাইড শেয়ার দেই।’ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নাজমুল হাসান আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। এখন শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করছেন। তিনি বলেন, আমি লার্নার লাইসেন্স নিয়েছি তিন মাস হলো। এখনো আসলটা পাইনি। লার্নার দিয়েই মোটরসাইকেল চালাই। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শুধু আমি না, অনেকেই লার্নার লাইসেন্স দিয়ে উবার, পাঠাওয়ে মোটরসাইকেল চালান। একবার একটি বড় দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন লার্নার লাইসেন্স দিয়ে নিবন্ধন বন্ধ থাকলেও এখন আবার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো যে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার বিষয়টি দেখছে নাÑতা স্বীকার করেছেন স্যামের প্রধান নির্বাহী ইমতিয়াজ কাসেম। তিনি বলেন, রাইড শেয়ারিংকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন অনেকে। অনেকে গ্রাম থেকে চলে এসেছেন মোটরসাইকেল চালাতে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো শুধু লাইসেন্স থাকলেই চালানোর অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে। কোনোমতে কাগজপত্র তৈরি করেই রাস্তায় নেমে যায়। কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় দুর্ঘটনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ‘লাভের ব্যাপার থাকায় চালকরা দ্রুত রাইড শেষ করতে চান, তাড়াহুড়ো করেন। কিন্তু আট টাকা থাকলে লোকজন অফিসে যাওয়া-আসার পথে কারো সঙ্গে রাইড শেয়ার করত। তাড়াহুড়োর কোনো ব্যাপার থাকত না।’

পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসাইন এম ইলিয়াসও স্বীকার করলেন, এর দায় কিছুটা তাদেরও আছে। দায়ভার অবশ্যই কিছুটা আছে। কিন্তু এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে সবাইকেই কাজ করতে হবে। আমরা যেহেতু সবাই মিলে কাজ করছি। ফল আসবেই।

শিক্ষানবিস লাইসেন্স থাকলেই রাইড শেয়ার করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লাইসেন্স থাকলেই কেউ ভালো ড্রাইভার নাও হতে পারেন। যাই হোক, আমরা চিন্তা করছি কীভাবে এ বিষয়টি আরো নিয়মের মধ্যে আনা যায়। এখন আর লার্নার দিয়ে কাউকে রাইড দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না। রাইডারদের জন্য বাড়তি কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটাও আমরা ভেবে দেখছি।

"