এম এ রউফ, সিলেট

  ২৪ মে, ২০১৮

‘ডাস্টবিনে নয়, অসহায় মানুষের মুখে অন্ন’

সিলেটে ১০ তরুণের ফুডব্যাংকিং

সিলেটের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ১০ জন তরুণের গল্প। সবাই নিজেদের পড়াশোনা ও কাজকর্ম নিয়ে যতটা না ব্যস্ত থাকেন, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ততা তাদের সমাজকে নতুনরূপে সাজানোর। জরুরি মুহূর্তে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, রোগীর রক্তের প্রয়োজনে রক্তদাতাদের ডেকে দেওয়া। দরিদ্র-অসহায় মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানো। দুর্ঘটনা-দুর্যোগে এগিয়ে যাওয়া। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দেওয়াÑ এসবই তাদের কাছে বড় কাজ। নিজেদের সমস্যাকে তুরি মেরে উড়িয়ে অদম্য তারুণ্য নিজেদের আগাগোড়াই সঁপে দিয়েছেন মানবতার কল্যাণে।

দিন কিংবা রাতে পথ হাঁটলেই চোখে পড়ে কোথাও না কোথাও অভুক্ত প্রাণ। মানুষ ডাস্টবিনে খুঁজছে অন্ন। সমাজকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর সেই ১০ তরুণের মনে এমন দুঃখচিহ্ন দাগ কেটে যায়। তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না এমন কষ্টদায়ক বাস্তবতা। ডাস্টবিনে খাবার খুঁজছে মানুষ। তাদের মতে, ‘ক্রমাগত জনসংখ্যার আধিক্য আর বিভিন্ন জায়গা থেকে নিঃস্ব মানুষের শহরমুখী হওয়ায় সুকান্তের কবিতার প্রতিফলন চোখে পড়ে নিত্যদিন।’

বলা হলো ফুডব্যাংকিং টিম সিলেটের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পাবলিক গ্রুপের মাধ্যমে নগরীর ১০ জন তরুণ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কার্যক্রম। সেটির তদারকি করে স্বার্থহীন সমাজকল্যাণ সংস্থা নামের একটি সংগঠন। ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে শুরু হয় পথচলা। রাস্তায় তাদের নজরে পড়ে ক্ষুধার জ্বালায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা ডাস্টবিনে খাবার খুঁজছেন। যে ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে সাধারণ মানুষ নাক চেপে ধরেন দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণের আশায়, সেই ডাস্টবিনেই আবার মানুষ হাতড়ে বেড়ায় খাদ্য; ক্ষুধার জ্বালায়।

সেই পরিকল্পনা থেকে মাহবুব খানের উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে স্বার্থহীন সমাজকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে সিলেট নগরীতে পথচলা শুরু করে ‘ফুড ব্যাংকিং টিম সিলেট’। মাহবুব খান প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন থেকে তার সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের আরো ৯ জনকে যুক্ত করেন। ফেসবুকে চালু করেন ফুডব্যাংকিং টিম সিলেট নামের পাবলিক গ্রুপ। ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংগঠনের কর্মীরা নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে ১০০ প্যাকেট খাবার প্রস্তুত করেন। পরে সেগুলো সিলেট নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অসহায়দের মাঝে বিতরণ করেন। শুরু হলো কার্যক্রম। সামনের সেপ্টেম্বরে এক বছরে গড়াবে তাদের কার্যক্রম। এরই মাঝে মোট ৩৮ বার তারা অসহায়দের জন্য খাবার বিতরণ কার্যক্রম করেছেন। আর এসব খাবারগুলো তারা সংগ্রহ করেছেন নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে।

এছাড়া নিজেরা ১০ জনসহ আরো ৫০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে চালু করেন নিজের মধ্যে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের জন্য পৃথক আরেকটি অফিসিয়াল গ্রুপ। সেটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় পারস্পারিক যোগাযোগ। যার মাধ্যমে এক নোটিশেই নগরীর যেকোনো স্থানে জড়ো হয়ে যেতে পারেন ফুডব্যাংকিংয়ের স্বেচ্ছাসেবক দল।

যেভাবে খাবার জমা পড়ে ফুডব্যাংকিং টিমের কাছে নগরীর যেকোনো স্থানের বাসা-বাড়ি, রেস্টুরেন্ট, খাবারের দোকান, হোটেল, কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে, আকিকা, জন্মদিন বা যেকোনো অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো সংগ্রহ করার জন্য ফেসবুকে প্রচারণা চালানো হয়। টিমের পাবলিক গ্রুপ থেকে খবরটি ছড়িয়ে যায় বিভিন্নজনের কাছে। টিমের গ্রুপে কলসেন্টারের দুইটি নাম্বার দেওয়া আছে। সেগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। গ্রুপের ১০ জন এডমিন পালাবদল করে ২৪ ঘণ্টাই অনলাইনে অ্যাকটিভ থাকেন।

কলসেন্টারে কল আসার পরপরই দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিমের সদস্যরা ছুটে যান খাবার সংগ্রহে। সেগুলো নিয়ে আসা হয় নগরীর জেলরোডের সামিরা কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় বসবাসকারী গ্রুপের অ্যাডমিন জাহিদ হাসান ইমনের কক্ষে। এই কক্ষটি ফুডব্যাংকিং টিমের অস্থায়ী যোগাযোগের ঠিকানাও বলাচলে। সেখানে খাবারগুলো প্যাকেট করা হয়। প্যাকেট করা শেষ হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই খাবার নিয়ে টিমের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা পৃথক পৃথকভাবে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়েন অন্নহীনের খোঁজে।

একদল ছুটে যান রেলস্টেশনে। অন্যদল ক্বিনব্রিজে কিংবা হযরত শাহ্ জালাল (রঃ) এর মাজার এলাকায়। নিরাপত্তার কারণে তাদের গলায় ঝোলানো থাকে পরিচয়পত্র। খুঁঁজে খুঁজে তারা অসহায়দের মুখে তুলে দেন খাবার। প্রক্রিয়াটি তদারকি করেন স্বার্থহীন সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোক্তা ও ফুডব্যাংকিং টিমের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন মাহবুব খান। টিমে অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করছেন, বাবুল আহমদ, জাহিদ হাসান ইমন, রাকুল সিংহা, মিসবাউল হক, আবুল মস্তাক, মাসুদুর রহমান মাসুদ, রুহেল আমিন, রাসেল মিয়া ও মালিহা মেহনাজ মিয়া। আর ১০ জনের এই টিমকে কাজে সহযোগিতা করেন আরো ৫০ জনের অধিক তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছাসেবক। তারা ব্যস্ত থাকেন খাবারগুলো নষ্ট হওয়ার আগে অসহায় মানুষের মুখে তুলে দিতে। কেউ হেঁটে, কেউ বাইসাইকেলে, কেউ মোটরসাইকেলে। কেউ রিকশাযোগে পৌঁছে দেন খাবার।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফুডব্যাংকিং টিম সিলেটের অ্যাডমিন রাসেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ডাস্টবিনে নয়, অসহায় মানুষের মুখে অন্ন’ স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের চলা। আমরা চাই মানুষ সচেতন হোক। আমাদের দেশে প্রতি বছর মোট খাদ্যের ১৫ শতাংশই অপচয় হয়। আমরা সচেতন হলে অন্নহীন মানুষের স্বপ্ন কিছুটা পূর্ণ হবে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোর স্বপ্ন হলো দু’বেলা দু’মুঠো খাবার খাওয়া। তিনি জানালেন, তাদের কোনো ফান্ড কিংবা চাঁদা গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। সংগ্রহ করা খাবার প্যাকেট করা এবং সেটি পৌঁছে দিতে যে অর্থের প্রয়োজন পড়ে, সেগুলো তারা (অ্যাডমিন) বিভিন্ন মাধ্যমে যোগান দিয়ে থাকেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist