এম এ রউফ, সিলেট
সিলেটে স্বপ্ন দেখছে ঝরে পড়া শিশু শিক্ষার্থী
সিলেটে ঝরে পড়া সাড়ে তিন হাজার শিশু শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়মুখী করা হয়েছে। সরকারের সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্পের আওতায় তাদের অভিভাবকদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্র। সিলেট সদর উপজেলা খাদিম নগর উপজেলার পাহাড়ি এলাকার শিশুরা শিক্ষাসহ মৌলিক সুবিধাগুলো পাচ্ছে না। মূলত এলাকার চারিদিকে চা বাগান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দূরে, পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে এসব এলাকার শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাবা-মা চা-শ্রমিক হওয়ায় সংসার চালিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না।
বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্প আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে চা বাগানের শিশুদের মধ্যে। সেই সঙ্গে ভাবনার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে তাদের অভিভাবকদের। তারা নিজেরা বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও তাদের সন্তানদের এ পেশায় আনতে চান না। সরকারি, বেসরকারি ও এনজিওর ব্যাপক কার্যক্রমের ফলে চা-শ্রমিকদের মধ্যে এ পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
খাদিমনগর চা বাগানের শ্রমিক রমজান আলী (৪০) কাজ করেন চা বাগানে। তার বাবা কাজ করতেন চা শ্রমিক হিসেবে। মাও কাজ করতেন চা বাগানে। মা অবসর নেওয়ার পর সেই কাজে যোগ দিয়েছে বড় ভাই। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর সেই কাজ করছেন তিনি। এভাবে একজনের পর আরেক জন যুক্ত আছে চা-শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু তার এক মেয়েকে দিয়েছেন স্কুলে। তিনি জানান, আমরা চা-শ্রমিক হলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে অন্য কাজে দিতে চাই।
কেন্দ্রটি হওয়ায় আমাদের খুব ভালো হয়েছে, আমাদের শিশুরা আগে পড়ালেখা করত না, ঘুরে বেড়াত এখন কেন্দ্রটিতে আমাদের শিশুরা নিয়মিত পড়াশুনা করে। শিক্ষিকারাও খুব ভালোভাবে তাদের আদর করে পড়ান এবং আমাদের শিশুরাও ভালোভাবে পড়ালেখা করছে। আমাদের আর চিন্তা করতে হয় না। এখানে শিশুরা অভিনয়ের মাধ্যেমে ছড়া, গান ও কবিতা আবৃত্তি করছে। কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রটি যেন আমাদের শিশুদের ছেড়ে না যায়। প্রায় একই কথা বলেন চা-শ্রমিক ভুট্টু মিয়া, মধু ভূমিজ, রনি দাসসহ অনেক অভিভাবক।
আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্র ঝরে পরা ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পাশে আরডিআরএস বাংলাদেশ সেভ দ্য চিলড্রেন এর সহযোগিতায় সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্প শিখন রুরাল মডেল সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় এক হাজার লার্নিং সেন্টার চালু করেছে। যেখানে ৩০ হাজারের অধিক সুবিধা বঞ্চিত ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থী মান সম্মত শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে সিলেট জেলার সদর উপজেলায় ১১৯ টি শিখন কেন্দ্র চালু রয়েছে যেখানে প্রায় তিন হাজার ৫৭০ জন সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করছে। খাদিমনগর ইউনিয়নের খাদিম ও লালিছড়া চা বাগানের বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শিক্ষিকা রিয়া রানী পাল ও মুক্তা রায় অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের পাঠদানে সহযোগিতা করছেন।
সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্পের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর, মো. কহিনূর ইসলাম তাদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন। তিনি বলেন, শিশুদের বিনামূল্যে ব্যাগ, খাতা, কলম, পেন্সিল, স্কুল পোশাকসহ শিক্ষা উপকরণ দিয়ে এসব শিশু শিখন কেন্দ্রে বিনামূল্যে পড়ানো হয়। প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি এসব পাঠশালায় শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চাও করানো হয়। এখানে কমিউনিটির সহযোগিতায় ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের সংগ্রহ করে পড়ানো হচ্ছে। এসব কেন্দ্রের শিশু পূর্ণিমা কর্মকার (১১), মৌমিতা ভূমিজ (১১), রাজু কর্মকার (১০), রাজ গোয়ালা (১০), লক্ষী লোহার (১১) জানায়, স্কুলটি আমাদের খুব ভালো লাগে। আপা আমাদের আদর করে পড়ায়। কোনো কিছু না বুঝলে আমাদের মতো করে বুঝিয়ে দেয়। আমরা একদিন স্কুলে না আসলে আপা আমাদের বাড়িতে যায়, নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। আমাদের দাবি আশার আলো শিখন কেন্দ্র যেন সব সময় আমাদের পাশে থাকে এটাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
খাদিমনগর ইউনিয়নের খাদিম চা বাগানের আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রের শিক্ষিকা রিয়া রানী পাল জানান, পাহাড়ি এলাকার শিশুরা শিক্ষাসহ মৌলিক সুবিধাগুলো পাচ্ছে না। মূলত এলাকার চারিদিকে চা বাগান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দূরে, পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে এসব এলাকার শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাবা-মা চা-শ্রমিক হওয়ায় সংসার চালিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। তাই বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি। ভালো ফলাফলও পাচ্ছি চা-শ্রমিকদের পরিবারের কাছ থেকে। খাদিমনগর চা বাগানের আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রের সভাপতি রুকু মিয়া জানান, খাদিমনগর ইউনিয়নের খাদিম ও লালিছড়া চা বাগানের বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের পাঠদানে সহযোগিতা করছেন। শিশুদের বিনামূল্যে ব্যাগ, খাতা, কলম, পেন্সিল, স্কুল পোশাকসহ শিক্ষা উপকরণ দিয়ে এসব শিশু শিখন কেন্দ্রে বিনামূল্যে পড়ানো হয়।
"