নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর ফুটপাতের ৮৮ শতাংশ খাবারে জীবাণু
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে বিক্রি হওয়া খাবারে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। এসব খাবার সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়। নগরে কাজের প্রয়োজনে আসা বিপুল সংখ্যক মানুষ এসব খাবারের ওপর নির্ভরশীল। যদিও রাস্তার খাবার কিংবা সাধারণ রেস্তোরাঁর খাবার কতটা স্বাস্থ্যকর; এমন প্রশ্ন রয়েই যায়। অন্যদিকে, অনেকেই আবার শখের বশেও প্রতিনিয়ত খাচ্ছেন এসব খাবার। রাস্তার পাশে চটপটি ও ফুচকার জনপ্রিয়তা তারই প্রমাণ দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন বিপজ্জনক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওইসব মুখরোচক খাবার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানী ঢাকার ফুটপাতের ৫৫ শতাংশ খাবারে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। বিক্রেতাদের ৮৮ শতাংশের হাতেই থাকে নানা জীবাণু। প্রতিদিন একজন বিক্রেতা গড়ে প্রায় দেড় শ জনের কাছে এমন পথের খাবার বিক্রি করেন। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে, চটপটি, ফুচকা, ঝালমুড়ি, পিঠা, রুটি, পরোটা, শরবত, ডিম-সেদ্ধসহ নানান খাবার।
মতিঝিলে জিয়াউদ্দিন নামের এক চা দোকানি বলেন, বিভিন্ন অফিসের কর্মজীবীরা কাজের ফাঁকে কিংবা শিক্ষার্থীরা ক্লাসের ফাঁকে এখানে খাবার খেতে আসেন।
ব্যাংক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ব্যাংকে কাজ করার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। ফলে এসব ফুটপাতের দোকানেই খেতে হয়। যদিও এটা খাওয়া ঠিক না। কারণ অনেক ধুলো-বালি থাকে। অনেক সময় ঠিকমতো কাপও ধুতে পারে না। আমরা হয়তো জেনেশুনেই ময়লা খাচ্ছি। কারণ কম টাকায় চা-বিস্কুট পেতে চাইলে ফুটপাতের দোকানই ভরসা।
আইসিডিডিআরবির সহযোগী বৈজ্ঞানিক ড. আলেয়া নাহিদ বলেন, ফুটপাতে যারা খাবার বিক্রি করেন তাদের বসার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তাই ফুটপাতেই বসছে। এতে ধুলোবালি জীবাণু সহজেই মিশে যাচ্ছে। খাবার বানাচ্ছে হাত দিয়ে; কিন্তু তা ভালো করে ধুতে পারছে না। ফলে তাদের হাত থেকে রোগ-জীবাণু মিশে যাচ্ছে খাবারে। আরামবাগের এক হোটেলকর্মী বলেন, যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করি। ফিল্টার পানিরও ব্যবস্থা রেখেছি।
গবেষকরা বলেছেন, প্রায় ৯০ শতাংশ বিক্রেতার হাতেই জীবাণু থাকে। যদিও এ পরিসংখ্যানের ব্যক্তি ও সংস্থা ভেদে পার্থক্য দেখা যায়। তারা বলেন, টাইফয়েড, আমাশয়, ডায়রিয়া থেকে শুরু করে খাদ্য এবং পানিবাহিত যেকোনো রোগের কারণ হতে পারে ফুটপাতের খাবার। বিক্রেতাদের সচেতন করতে পারলে এই জীবাণুর সংক্রমণ কমানো যায়। তাই দ্রুত এসব পথ-খাবার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকা এই ফুটপাতের খাবারের মান তদারকিতে একটি বড় সমস্যা- এগুলো ভ্রাম্যমাণ। হোল্ডিং নম্বর না থাকায় তাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়াও সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, ঢাকার কয়েক লাখ রিকশাচালক প্রতিদিন রাস্তার পাশেই খাচ্ছেন সস্তা ও মানহীন খোলা খাবার। ব্যস্ত অফিস কিংবা মার্কেটের আশপাশে যেসব খাবারের দোকান গড়ে উঠে সেগুলোতে খাদ্য উপাদানের চেয়ে আবর্জনার পরিমাণ বেশি। কার্যকর তদারকি না থাকায় রাস্তার পাশের খাবার হোটেল কিংবা খোলা খাবারের দোকানগুলো হয়ে উঠছে রোগজীবাণুর অন্যতম উৎস।
রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি, ফুটপাথসহ বিশেষ করে স্কুল-কলেজের সামনে অসংখ্য খোলা খাবার বিক্রি হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার। অভিভাবকের বাধা থাকা সত্ত্বেও তারা এসব খাবার খাচ্ছে।
দেশের একমাত্র খাদ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার ৪৬টি স্কুলের সামনে থেকে ঝালমুড়ি, ফুচকা ও আচারের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোতে কৃত্রিম রং, ইস্ট, কলিফর্ম, মাইকোটক্সিন, সিসার মতো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছে।
সংস্থাটির দাবি, খোলা খাবারের জীবাণু দ্বারা খুব সহজেই শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। সংগ্রহ করা ঝালমুড়ি, ফুচকা ও আচারের নমুনাতে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম এবং সালমোনিলা পাওয়া গেছে। ফুচকার সব কটিতে মেলে কলিফর্ম, ইস্ট মোল্ড।
অনেকের চাহিদা মেটালেও জনস্বাস্থ্যের দিকটি সর্বাগ্রে ফুটপাতে এমন মুখরোচক খাবারে লোভ সামলানো অনেকের পক্ষেই কঠিন। কিন্তু খুব কম মানুষই জানে এসব খাবার কতটা ভয়ংকর। তাই তা খাওয়ার আগে সচেতন থাকা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এসব খাবারের উৎপাদন থেকে পরিবেশন, প্রতিটি ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এর মাঝেই এক গবেষণা দিচ্ছে ভয়ংকর তথ্য। তাতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৬০ লাখ মানুষ ফুটপাতের খাবার খায়।
"