বিবিসি

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৮

ঢাকায় কবরস্থানের এত অভাব কেন?

ঢাকার মিরপুরে ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন সুরাইয়া পারভীন। কিন্তু কথা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গালে গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। তিনি বর্ণনা করছিলেন কীভাবে হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন তার বাবার কবরের ওপরে অন্য কাউকে কবর দিয়ে সেটি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি জানালেন, আমার বড় ভাই কবরটি দেখাশোনা করতে একটু বেশিই যেতেন। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, গিয়েছিলেন আজকে? তিনি জানালেন, আব্বার কবরের ওপরে তো আরেকজনের কবর হয়ে গেছে। তারা বাঁধাই করে ফেলেছেন কবর। কথাটা শুনে আমি খুব আহত হলাম। বিষয়টি আমার কাছে ছিল একদম বজ্রপাতের মতো। আমি এভাবে আমার বাবার শেষে চিহ্নটুকুও হারালাম।

সুরাইয়া পারভীন বলেন, জানতে পারলে হয়তো কোনো ব্যবস্থা নিতেন। ইসলাম ধর্মের আলেমদের বক্তব্য অনুযায়ী পুরোনো কবরের ওপরে কবর দেওয়া যায়। মিরপুরে কালসি কবরস্থানে স্থান পেয়েছিল সুরাইয়া পারভীনের বাবা, মা, তার প্রথম সন্তান ও মামার মরদেহ। একইভাবে প্রতিটি কবর হারিয়েছেন তিনি। বাবার কবরটি ছিল সর্বশেষ।

ঢাকায় বেশির ভাগ কবরই এখন দুবছর পর পর ভেঙে ফেলা হয়। নগরীর বিভিন্ন কবরস্থানে একই কবরে একের অধিক মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে দেখা গেল, অসংখ্য কবর একটি আরেকটির গায়ে লাগানো। কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। প্রচুর কবরের ওপরে দেখতে পেলাম একের অধিক সাইনবোর্ড লাগানো। অর্থাৎ একের অধিক মানুষের জায়গা হয়েছে একেকটি কবরে। কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবার থেকে, ভিন্ন এলাকা থেকে তারা এসেছেন। ঢাকা শহরে মরদেহ সৎকারের জায়গা সব ধর্মের জন্যই খুব সীমিত হয়ে গেছে।

ঢাকায় আটটি সরকারি কবরস্থান রয়েছে। আজিমপুরের কবরস্থানটিতে ৩০ হাজারের মতো কবরের জায়গা হয়। ঢাকার বনানী কবরস্থানে রয়েছে ২২ হাজার কবরের জায়গা। ২০০৮ সাল থেকে দক্ষিণের জুরাইন ও আজিমপুরে আর ২০১২ সাল থেকে ঢাকা উত্তরের ছয়টি কবরস্থানে স্থায়ীভাবে আর কোনো কবরের জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ বছর, এরকম নানা মেয়াদে সেখানে জায়গা বরাদ্দ আছে খুব অল্প কিছু কবরের।

যার জন্য দেড় থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। কিন্তু সেটি যারা পারছেন না, তাদের জন্যেই অস্থায়ী কবর। আর সেই সংখ্যাটিই বেশি। দুবছর পর পর সেসব কবরে যোগ করা হয় আরেকটি মরদেহ।

১২ বছর আগে বোনের আত্মহত্যার পর থেকে বিভিন্ন উপায়ে তার কবরকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে এমন একজন জানালেন, আমার বোনের কবর আজিমপুরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কারণ, আমরা ভাইবোনেরা সবাই ঢাকাতেই থাকি। ২২ মাস পর হঠাৎ জানতে পারলাম কবরটি ভেঙে ফেলা হবে। আমরা কবরটির দেখাশোনা করার জন্য একজনকে রেখেছি। প্রতি বছর হয় আগস্ট ও ফেব্রুয়ারি এরকম সময়ে সে খবর দেয় যে আপা কবর ভাঙবে। আমি তাকে প্রতি মাসে টাকা দেই কিন্তু ওই সময়ে একটু বেশি দিই। এভাবেই ১২ বছর ধরে ওর কবরটা আমরা টিকিয়ে রেখেছি।

ঢাকার পোস্তগোলা ও কামরাঙ্গিরচরে রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মরদেহ সৎকারের জন্য রয়েছে দুটি সরকারি শ্মশান। রাজারবাগে কালি মন্দিরে রয়েছে বেসরকারি একটি শ্মশান। খবর নিয়ে জানা গেল, দিনে দুটির বেশি সৎকার এই শ্মশানগুলোতে হয় না। একসময় বিশাল যায়গা নিয়ে তৈরি এসব শ্মশান এখন ভূমি দস্যুদের দখলে এক চিলতে জমিতে পরিণত হয়েছে। ভূমির অভাবে কবর নিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছে ঢাকার খ্রিস্টানদের সেমেটারিগুলো। তেজগাঁওয়ে হোলি রোজারি চার্চে রোববারের প্রার্থনা চলাকালীন সেখানে গিয়ে দেখলাম সাদা ক্রুশ চিহ্ন বসানো সারি সারি পাঁচশোর মতো কবর।

অনেক ছিমছাম আর গোছানো সেগুলো। কিন্তু পাঁচ বছর পরপর একইভাবে পুরোনো কবরে সমাহিত করা হয় নতুন মরদেহ। প্রধান পুরোহিত ফাদার কমল কোরাইয়া বলছিলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ চার্চের সঙ্গে সমাহিত হতে চান। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুদান পাই না। চার্চের কবরস্থানগুলো চার্চের পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কবরগুলো খুব যতেœ রাখা হয়। আমাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে চার্চে কবর হলে তা পবিত্র থাকে। তাই অনেকেই চার্চে কবর চান। কিন্তু বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা নতুন জমি কেনার চিন্তা করছি। ঢাকায় খ্রিস্টানদের জন্যে আরো দুটি কবরস্থান রয়েছে ওয়ারী ও মোহাম্মদপুরে। সেখানেও একই রকম অবস্থা।

মৃত্যুর পরও মরদেহের জন্য একটুখানি জায়গা যে দরকার হয় তা মাথায় রেখে সেভাবে কোনো পরিকল্পনাই করা হয়নি ঢাকা শহরে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মরদেহ নিজেদের জেলায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। তা বুঝতে পারলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগে গিয়ে। সেখানে জানতে পারলাম, ব্যক্তিগত আবাসিক ভূমি উন্নয়নবিষয়ক আইনে ঢাকা শহরে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক শূন্য চার একর জমি রাখার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, মরদেহ সৎকার ও কমিউনিটির অন্যান্য সামাজিক সুবিধার জন্য।

যেকোনো নতুন আবাসিক এলাকা তৈরির ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করেই এর পরিকল্পনা পাশ করানোর নিয়ম। কিন্তু এই নিয়ম করা হয়েছে মাত্র ২০০৪ সালে। নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আফসানা হক বলছিলেন, ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য একটা মাস্টার প্লান হয়েছিল। এরপর পরবর্তীতে প্ল্যান আমরা পেলাম ১৯৯৫ সালে। তারপর ২০১৫ সালের জন্য। ইন বিটুইন কোনো পরিকল্পনাই হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা এখন দেড় কোটির ওপরে। সরকারি হিসেব মতেই সেটি ২০৩৫ সালে এসে দাঁড়াবে আড়াই কোটির বেশি। সামনে যে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে সেটি সম্ভবত বলাই যায়। ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সামনের কঠিন সময়ের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ? দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলছেন, তার এলাকার অধিবাসীদের মরদেহ নিজেদের জেলায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং মরদেহ গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ও সৎকারের জন্য কিছু খরচ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি বলছেন, ধরুন ঢাকা শহর থেকে টেকনাফ যেতে হবে বা কুড়িগ্রাম যেতে হবে। তার জন্য আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করব। আমরা যদি সেই ব্যবস্থা করি তাহলে হয়তো অনেকে ঢাকায় কবর দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবেন। আর ঢাকা উত্তর বানাচ্ছে নতুন কবরস্থান, বললেন এর প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. আবরাউল হাসান মজুমদার।

তিনি জানিয়েছেন, আমরা চেষ্টা করেছি নতুন কিছু কবরস্থান তৈরি করার জন্য। ঢাকার রায়েরবাজারে প্রায় ৮১ একর জায়গার ওপর নতুন একটি কবরস্থান হয়ে গেছে। যেখানে ৯০ হাজার কবর ধরবে। সেটি সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কবরস্থান। এ ছাড়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ড সংযুক্ত হচ্ছে উত্তরের সঙ্গে। সেখানে নতুন কবরস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে। সুন্দর করে সাজানোর প্ল্যান যাতে ভাবগাম্ভীর্য বজায় থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist