প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯

হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতি

ভারতের ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, নৃত্যকলা, সংগীত, স্থাপত্যশৈলী, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক-পরিচ্ছদে অঞ্চলভেদে ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসবের মধ্যে একটি সাধারণ একাত্মতা পরিলক্ষিত হয়। ভারতের সংস্কৃতি কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতির একটি সম্মিলিত রূপ।

ভারতীয় সভ্যতা প্রায় আট হাজার বছরের পুরনো। এই সভ্যতার একটি আড়াই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসও রয়েছে। এ কারণে কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই সভ্যতাটিকে ‘বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত সভ্যতা’ মনে করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্ম, যোগ ও ভারতীয়দের খাদ্যপ্রীতি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সভ্যতার এই উপাদানগুলো সমগ্র বিশ্বে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

ভারত হলো হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও শিখধর্মের উৎপত্তিস্থল। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, এই চারটি ধর্ম একত্রে ভারতীয় ধর্ম নামে পরিচিত। ভারতীয় ধর্মগুলো আদি ধর্মগুলোর মতোই বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় যূথ। বর্তমানে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম যথাক্রমে বিশ্বের তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম ধর্মবিশ্বাস। এই দুই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা ২ বিলিয়নেরও বেশি। (সম্ভবত ২.৫ বা ২.৬ বিলিয়ন)। লিঙ্গায়েত ও আহমদিয়া ধর্মমতের উৎপত্তিস্থানও ভারত।

ভারতের জনসাধারণের মধ্যে যে ধর্মকেন্দ্রিক পার্থক্য ও মিল রয়েছে, তা বিশ্বের আর কোনো দেশে দেখা যায় না। এই দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রায় ধর্মই কেন্দ্রীয় ও প্রধান ভূমিকা পালন করে। ভারতে সামাজিক অন্য আচার অনুষ্ঠানও ধর্মকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে। আর ধর্মই হচ্ছে ভারতে সবচেয়ে স্পর্শকাতর। বহুধর্মের মানুষের ধর্মচর্চা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যই দেশটির সংবিধান সেক্যুলার, যা বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুসরণীয়।

ভারতের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দুধর্মের অনুগামী। ১৩ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। তা সত্ত্বেও শিখধর্ম, জৈনধর্ম ও বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে প্রতীয়মান। খ্রিস্টধর্ম, জরথুস্ত্রবাদ, ইহুদি ধর্ম ও বাহাই ধর্মের কিছু প্রভাব ভারতের সংস্কৃতিতে থাকলেও, এই ধর্মগুলোর অনুগামীর সংখ্যা অনেক বেশি নয়। ধর্ম ভারতীয়দের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরধর্মসহিষ্ণুতাও সাধারণ ভারতীয়দের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভারতের মতো বহুধর্মের অস্তিত্বসম্পন্ন দ্বিতীয় দেশটি পৃথিবীতে আর নেই।

সংস্কৃতিবিশেষজ্ঞ ইউজিন এম মাকারের মতে, ভারতের প্রথাগত সংস্কৃতির ভিত্তি আপেক্ষিকভাবে কঠোর এক সামাজিক ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাস। তিনি আরো বলেছেন, শিশুদের অতি অল্পবয়স থেকেই তাদের সামাজিক কর্তব্য ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়। ভাতীয়দের অনেকেই অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী। তারা চেতনার গভীর থেকে বিশ্বাস করেন, মানুষের জীবনকে চালনা করেন দেবতা ও উপদেবতারা। বর্ণাশ্রম প্রথা দেশের একটি শক্তিশালী সামাজিক বিভাজন রেখা। সহস্রাধিক বছর ধরে উচ্চবর্ণের মানুষরা সামাজিক বিধিনিষেধগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তবে সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, এই বিভাজন অনেকটাই নির্মূল হয়েছে। গোত্রব্যবস্থা হিন্দুদের পারিবারিক জীবনের একটি বিশিষ্টতা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবারগুলোর সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্ক রক্ষিত হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে, এমনকি কখনো কখনো শহরাঞ্চলেও একই পরিবারের তিন কিংবা চারটি প্রজন্মকে একই ছাদের তলায় বসবাস করতে দেখা যায়। পুরুষতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পারিবারিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়ে থাকে।

ভারতের সংস্কৃতিতে পরিবারের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ দেশে একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা চলে আসছে। এ ব্যবস্থায় বাবা-মা, ছেলে-পুত্রবধূ ও তাদের সন্তান-সন্ততি প্রভৃতি একসঙ্গে বসবাস করে। সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্যই একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা হন। তিনিই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং নিয়মকানুন স্থির করে দেন। পরিবারের অন্য সবাই তাকে মান্য করে চলে। তবে এখন শহরের পরিবারগুলোতে একক পরিবারের প্রচলন হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

পূর্বপরিকল্পিত বিয়ে বা সম্বন্ধ করে বিয়ে ভারতের একটি শতাব্দীপ্রাচীন প্রথা। আজও ভারতীয়দের অধিকাংশের বিয়ে হয় বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সম্মানীয় সদস্যদের পরিকল্পনা এবং বর ও বধূর সম্মতিক্রমে। পণপ্রথা থাকলেও, ভারত সরকার তা বেআইনি ঘোষণা করেছে। তবে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই প্রথা রয়েই গেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে পণ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটি গোপন রাখা হয়ে থাকে। সম্বন্ধ করে বিয়েতে বয়স, উচ্চতা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও রুচি, পারিবারিক প্রেক্ষাপট (অর্থবল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা), বর্ণ ও ঠিকুজি-কোষ্ঠী বিচার করে পাত্রপাত্রী নির্বাচন করা হয়।

ভারতীয় সংস্কারে বিয়ে হলো সারা জীবনের সম্পর্ক। ভারতে বিয়েবিচ্ছেদের হার অত্যন্ত কম (মাত্র ১.১%, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৫০ শতাংশ)। সম্বন্ধ করে বিয়েতে বিয়েবিচ্ছেদের হার আরো কম। তবে সাম্প্রতিককালে বিয়েবিচ্ছেদের হার তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাচীনপন্থিরা বিয়েবিচ্ছেদকে সামাজিক রীতি লঙ্ঘন মনে করলেও, আধুনিকতাবাদীরা নারীর অধিকার রক্ষায় এটিকে জরুরি মনে করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close