ক্রীড়া ডেস্ক

  ০৯ আগস্ট, ২০২০

তুরিনে অঘটন, ম্যানচেস্টারে রিয়ালের পতন

করোনাঘাতে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের রাতের সৌন্দর্য ভুলতে বসেছিলেন ফুটবল অনুরাগীরা। প্রাণঘাতি ভাইরাসের কারণে অন্যান্য শীর্ষ লিগের মতো স্থগিত হয়ে গিয়েছিল ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাকর এই আসরটিও। সব জল্পনা-কল্পনা শেষে পরশু রাতে আবার দেখা গেছে হেভিওয়েটদের দ্বৈরথ। ১৪৭ দিন পর ফেরা আসরের শুরুতেই ঘটেছে অঘটন। ‘নিউ নরমাল’ জামানার প্রথম রাতে অলিম্পিক লিওঁর বিপক্ষে জিতেও অ্যাওয়ে গোলের মারপ্যাঁচে বিদায় নিতে হয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাসকে। রাতের অপর ম্যাচে টুর্নামেন্টের সফলতম দল রিয়াল মাদ্রিদকে আরেক দফা হারের তিক্ত স্বাদ দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেছে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। আগামী ১৫ আগস্ট পতুর্গালের রাজধানী লিসবনে শেষ চারে ওঠার লড়াইয়ে লিওঁর মুখোমুখি হবে ম্যানসিটি।

রোনালদো জ্বললেও নিভল জুভেন্টাস

ম্যাচ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই চরম বিতর্কিত এক পেনাল্টিতে পিছিয়ে পড়ে জুভেন্টাস। পরে আরেক পেনাল্টি থেকে গোল করে ম্যাচে সমতা আনেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিরতির পর পর্তুগিজ মহাতারকা দুর্দান্ত আরেক গোলে এগিয়েও নেন দলকে। তবু লাভ হয়নি। বিতর্কিত ওই অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে পরের রাউন্ডে চলে গেছে অলিম্পিক লিওঁ।

পরশু রাতে ঘরের মাঠ অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর ফিরতি লেগে লিওঁকে ২-১ গোলে হারিয়েও হতাশায় নুয়ে পড়তে হয়েছে ইতালিয়ান জায়ান্টদের। দুই লেগ মিলিয়ে সমান ২-২ গোল হলেও অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে শেষ আট নিশ্চিত করেছে ফরাসি ক্লাব লিওঁ।

নবম মিনিটে রেফারির বাজে সিদ্ধান্তে ভুগতে হয় জুভেন্টাসকে। বক্সের ভেতর জুভ মিডফিল্ডার বেন্তানকুর বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে পা সামান্য স্পর্শ করেছিল আউয়ার হিলে। রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা গেছে, বলের উপস্থিতিতে বৈধ ট্যাকল করেছেন বেন্তানকুর। কিন্তু অতি সাধারণ শরীর স্পর্শেই পেনাল্টি দিয়ে বসেন জার্মান রেফারি ফেলিক্স জাওয়ার। মেম্ফিস ডিপের সফল স্পট কিকে এগিয়ে যায় লিওঁ।

কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে হলে অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে জিততেই হতো জুভেন্টাসকে। এই অবস্থায় মরিয়া হয়ে ওঠেন হিগুয়েইন-বার্নারদেস্কিরা। একের পর এক আক্রমণে চলে গোল আদায়ের চেষ্টা।

১৭ মিনিটে বার্নারদেস্কি ডানপ্রান্ত দিয়ে তিনজনকে কাটিয়ে ঢুকে যান বক্সে। পেরিয়ে গিয়েছিলেন গোলকিপারকেও। তার নেওয়া নিশ্চিত গোলমুখী শট লাইন থেকে ফিরিয়ে দেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার ফার্নান্দো মার্কাল। পরের মিনিটে রোনালদোর হেড বারের ওপর দিয়ে চলে যায়।

৩৯ মিনিটে সমতায় আসতে পারত জুভরা। রোনালদোর দারুণ ফ্রি কিক ডান দিকে ঝাঁপিয়ে অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় ঠেকিয়ে দেন লিঁওর গোলরক্ষক অ্যান্থনি লোপেজ। পরের মিনিটে একই জায়গায় আবার ফ্রি কিক পায় জুভেন্টাস। এবার রোনালদোর নেওয়া শট প্রতিপক্ষের ডিপের হাতে লাগলে পেনাল্টি পায় তারা। যদিও হাত দিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর অংশ সুরক্ষা করতে গিয়েছিলেন ডিপে। পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান রোনালদো।

বিরতির পর প্রথম কয়েক মিনিট তাল মেলাতে পাচ্ছিল না কোনো দল। বেশ কয়েক মিনিট উদ্দেশ্যহীন খেলার পর আসে কাক্সিক্ষত মুহূর্ত। ৬০ মিনিটে ডান পাশে বক্সের বাইরে বল পেয়ে বাঁ-পায়ের আড়াআড়ি আচমকা শটে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার রোনালদো। ম্যাচে প্রথমবার এগিয়ে যায় তুরিনের ওল্ড লেডিরা। ফের আশা জাগে তাদের।

এরপর আরো এক গোলের অনেক কাছেও গিয়েছিল ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নরা। ৬৮ মিনিটে রোনালদোর ক্রস হেডে বারের ওপর দিয়ে পাঠান হিগুয়েইন। ৭৫ মিনিটে কর্নার থেকে হ্যাটট্রিকের সুযোগ পেয়েছিলেন রোনালদো। তার জোরালো হেডও অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে বাইরে চলে যায়।

অন্তিম সময়ে বক্সের বাইরে পাওয়া ফ্রি কিক কাজে লাগাতে পারেননি রোনালদো। তাই ম্যাচ জিতলেও শেষ বাঁশি বাজতেই হতাশায় মাথা নুয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাদের। রোনালদোর কষ্টটা বোধহয় একটু বেশিই ছিল। কারণ, পরবর্তী রাউন্ড থেকে ফাইনাল পর্যন্ত সব ম্যাচ যে তার দেশ পর্তুগালেই হবে! অথচ জন্মভূমিতে খেলতে যাওয়া হচ্ছে না তার। সে হতাশাতেই কিনা ম্যাচ শেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সফলতম খেলোয়াড়।

রামোসের অনুপস্থিতিই ভোগাল রিয়ালকে

ম্যাচের আগেই আলোচনা হচ্ছিল, সার্জিও রামোসের না থাকা নিয়ে। প্রথম লেগে লাল কার্ড দেখে এই ম্যাচে খেলতে না পারা রামোসের অভাব ঠিক কতটুকু ভোগাবে রিয়াল মাদ্রিদকে? রামোসের জায়গায় মাঠে নামা এদের মিলিতাও রাফায়েল ভারানের সঙ্গে কতটুকু সফল হতে পারবেন?

প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরেই রিয়ালের জন্য বরাদ্ধ হয়েছে একরাশ হতাশা। দলের রক্ষণভাগকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে উল্টো? রাফায়েল ভারানে ভজকট পাকিয়ে ফেলেছেন। আর তারই চড়া মাশুল দিয়েছে রিয়াল। ভারানের জোড়া ভুলের এই ম্যাচে রিয়ালকে ২-১ গোলে হারিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। যে ম্যাচে রিয়ালের ন্যূনতম দুই গোল করতে হতো, সেখানে তারাই খেয়ে বসল দুই গোল। ফলে দুই লেগ শেষে ৪-২ গোলের অগ্রগামিতা বজায় রেখে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে ম্যানচেস্টার সিটি। আর টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পরের দুই মৌসুমেই দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়ার হতাশা সঙ্গী হয়েছে রিয়ালের। জিনেদিন জিদান পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার স্বাদ।

গতবারও দ্বিতীয় রাউন্ডে বাদ পড়ার পেছনে রিয়াল মাদ্রিদের মূল কারণ ছিল দ্বিতীয় লেগে অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক সার্জিও রামোসের অনুপস্থিতি। এবারও তাই। রামোসের না থাকা যে কতটা ভুগিয়েছে, সেটা বোঝা গেছে ম্যাচের প্রথম থেকেই।

স্টার্লিং-জেসুসরা জানতেন, রামোসহীন রিয়াল রক্ষণ ঝামেলায় পড়বেন। অধিনায়ক না থাকা সত্ত্বেও নিচ থেকে খেলা গড়তে চেয়েছিলেন রিয়াল তারকারা। একদমই কাজে লাগেনি সেই কৌশল। প্রথম গোলটা শুধু সে কারণেই খেয়েছে রিয়াল। সিটি তারকারা প্রেস করে যাচ্ছিলেন রিয়ালের বক্সের ভেতর পর্যন্ত। পাস দিতে গিয়ে কোর্তোয়াও তাই চাপে পড়ে যান। ভারানেকে কোনোরকমে পাস দিতে পারলেও ঝামেলা হয়ে যায় ভারানের জন্য। জেসুসের কাছে বল হারিয়ে বসলেন বিপজ্জনক জায়গায়। মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা স্টার্লিংয়ের দিকে বল এগিয়ে দিলেন। ইংলিশ তারকার শুধু পা টা ঠেকালেই গোল হয়ে যেত, যে কাজটা তিনি করেছেন কোনো ভুল ছাড়াই। ব্যস, দশ মিনিটের মধ্যেই এক গোলে পিছিয়ে গেল রিয়াল।

রিয়ালের আক্রমণভাগের ডানদিকে কে খেলবেন, ম্যাচ শুরুর আগে সেটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। অবশেষে ইসকো, ভিনিসিয়ুস বা ফেদেরিকো ভালভার্দেকে না নামিয়ে রদ্রিগোকে খেলান জিদান। সে ফাটকাটাও কাজে লেগে গিয়েছিল। ২৯ মিনিটে রদ্রিগো বাম প্রান্তে সিটির লেফটব্যাক জোয়াও ক্যানসেলোকে বোকা বানিয়ে দারুণভাবে কাটিয়ে ক্রস করলেন। বেনজেমার শুধু মাথা ঠেকালেই হতো। এ ম্যাচে সিটির সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলা ফার্নান্দিনহোকে বোকা বানিয়ে দুর্দান্ত এক হেডে দলকে সমতায় ফেরান বেনজেমা।

কিন্তু গোল দিয়েও লাভ হলো কোথায়? এই ম্যাচে যে ভারানে একাই সব আলো কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন! মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল হেড করে নিয়ন্ত্রণ করে গোলরক্ষক কোর্তোয়ার কাছে পাঠাতে চেয়েছিলেন তিনি। পারেননি। উল্টো? পেছনে থাকা সিটি স্ট্রাইকার জেসুস গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। ভারানের ভাগ্যে আবারো জোটে একরাশ হতাশা।

ম্যাচ খেলতে না পারলেও দলের সঙ্গে এসেছিলেন রামোস। ইতিহাদের গ্যালারিতে বসে পুরোটা সময়ই দলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে গেছেন। সেখান থেকেই দেখেছেন নিজের রক্ষণসঙ্গীর একের পর এক ভুল।

এর আগে ২০১০-১১ মৌসুমে বার্সেলোনার কোচ হয়ে রিয়ালকে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায় করেছিলেন গার্দিওলা। এবার দ্বিতীয়বার একই কাজ করলেন। ইউরোপের সবচেয়ে সফল ক্লাবকে দুইবার বাদ দেওয়া কোচের তালিকায় আগে ছিলেন শুধু মার্সেলো লিপ্পি আর অটোমার হিটজফিল্ড। এবার সে তালিকায় নাম লেখালেন গার্দিওলাও।

ফলাফল

জুভেন্টাস ২-১অলিম্পিক লিওঁ

ম্যানসিটি ২-১ রিয়াল মাদ্রিদ

১. কোচিং ক্যারিয়ারে প্রথমবার নক আউট পর্ব থেকে বিদায়

নেওয়ার স্বাদ পেলেন জিনেদিন জিদান।

২. ১৩ বছর পর এক ম্যাচে রিয়াল ডিফেন্ডারের দুটি সাংঘাতিক ভুলে গোল খাওয়ার লজ্জা সঙ্গী হলো রাফায়েল ভারানের।

২. ১১ বছর পর নকআউট পর্বের দুটি ম্যাচেই হারল রিয়াল।

সবশেষ রিয়ালকে দুই লেগেই হারানো দল লিভারপুল।

৩. রিয়াল মাদ্রিদকে দুবার বিদায় করা তৃতীয় কোচ পেপ গার্দিওলা। বাকি দুজন মার্সেলো লিপ্পি ও অটোমার হিটজফিল্ড।

৪. ৪ মৌসুম পর কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলো জুভেন্টাস। ২০১৫-১৬ মৌসুমে আলেগ্রির অধীনে শেষবার ব্যর্থ হয়েছিল তারা।

৬. টানা ৬ ম্যাচে গোল করা মাত্র দ্বিতীয় ডাচ ফুটবলার

মেম্ফিস ডিপে। আরেকজন রুড ফন নিস্টেলরয়।

৯. পরশু রিয়ালের বিপক্ষে একাই ৯টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন কেভিন ডি ব্রুইনা। গত ১৭ বছরে রিয়ালের বিপক্ষে এক ম্যাচে এতোগুলো সুযোগ তৈরি করতে পারেননি আর কেউ।

১১. অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে শেষ আট নিশ্চিত হলেও প্রতিপক্ষের মাঠে টানা ১১ ম্যাচে জয়হীন অলিম্পিক লিওঁ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close