জাহিদুল ইসলাম

  ১৯ জুলাই, ২০১৮

লড়াইটা এখন আর আগের মতো জমছে না

ফুটবলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর থেকেই বিভেদটা তৈরি হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের যুদ্ধটা চিরন্তন। ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ এই যুদ্ধে দিয়েছে অনন্য এক মাত্রা। শ্রেষ্ঠত্বে কোন মহাদেশ এগিয়ে তা নিয়ে এখনো লড়াই চলছে। দুই মহাদেশের খেলার কৌশল, ছন্দ এবং দর্শনই মূলত পার্থক্যটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।

দুই মহাদেশের এই ফুটবল যুদ্ধটা প্রায় সমানতালেই চলত। গত শতাব্দী পর্যন্তও সেটা অব্যাহত ছিল। বিশ্বকাপ মানেই যেন শ্রেষ্ঠত্বের অদল-বদল দুই মহাদেশের মধ্যে। কিন্তু চলমান শতাব্দীতে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল দ্বৈরথটা ঠিক জমছে না। ফুটবলের তীর্থভূমি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের মতো দেশগুলো পেরে উঠছে ইউরোপের দলগুলোর সঙ্গে। সবশেষ তিনটি বিশ্বকাপেই এই দলগুলো বিদায় নিয়েছে ইউরোপিয়ান দলগুলোর হাত ধরে। ল্যাটিন দলগুলোর মধ্যে এখন এমনই ছন্দের পতন হয়েছে যে টানা চার বিশ্বকাপ ধরে বিশ্বকাপ জিততে পারছে না দলগুলো। এই মহাদেশের পক্ষে সবশেষ ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। স্বপ্নের সোনালি ট্রফির জন্য ল্যাটিনদের এত দীর্ঘসময় কখনোই অপেক্ষা করতে হয়নি।

টানা চার বিশ্বকাপ ধরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে ইউরোপের দেশগুলো। এই চার আসরের মধ্যে তিনবারই হয়েছে অল ইউরোপিয়ান ফাইনাল। এর মধ্যে আর্জেন্টিনা গত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল। সদ্য সমাপ্ত রাশিয়া বিশ্বকাপ এর চেয়েও বড় হতাশা উপহার দিয়েছে ল্যাটিনদের। সেমিফাইনালে ছিল না তাদের কোনো প্রতিনিধি। ল্যাটিন তিন জায়ান্ট ব্রাজিল ও উরুগুয়েকে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় করে দিয়েছে যথাক্রমে বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কাছে। সাবেক চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা তো বিদায় নিয়েছে শেষ ষোলোতেই। তাদের ঘাতকও ছিল এবারের বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্স।

এ রকম বিশ্বকাপ এ নিয়ে পঞ্চমবার অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল দেখেছে ফুটবল দুনিয়া। রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে সবশেষ ২০০৬ বিশ্বকাপে এমনটা ঘটেছে। যেখানে প্রতিটি আসরেই শিরোপার দাবি ছিল ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার একদল। কিন্তু প্রতিবারই তাদের পথচলা থেমেছে জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের কাছে। এবার অবশ্য আর্জেন্টাইনদের বিদায় ঘণ্টা ফ্রান্স বাজালেও হট ফেভারিট ব্রাজিল হোঁচট খেয়েছে ইউরোপের উঠতি শক্তি বেলজিয়ামের কাছে।

বিশ্বকাপে দুই মহাদেশের লড়াইয়ের শুরু ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই। এবার রাশিয়াতে শেষ হয়েছে ফুটবল মহাযজ্ঞের ২১তম আসর। যেখানে সাফল্যে ইউরোপিয়ান মহাদেশই এগিয়ে। অথচ ২০০২ সাল পর্যন্তও এগিয়ে ছিল ল্যাটিন আমেরিকা। মোট ৯বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মহাদেশটি। ব্রাজিল পাঁচবার এবং আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে দুইবার করে শিরোপা জিতেছে। ২০০৬ সালে ইতালি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আসে সমতা। এরপর থেকে ইউরোপ শুধুই এগিয়েছে। ১২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে এই মহাদেশ। জার্মানি, ইতালি চারবার করে এবং দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছে ফ্রান্স। একবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইংল্যান্ড ও স্পেন।

তবে বিশ্বকাপ জয়ের লড়াইটা এক তরফা পরিণত হলেও দুই মহাদেশের ফুটবল যুদ্ধটা বেশ রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল ১৯৬২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। দুই মহাদেশের সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিসংখ্যানটা ছিল খুবই নিখুঁত। একবার ইউরোপ তো পরের বার ল্যাটিন আমেরিকা, এরপর ইউরোপ ঘুরে আবার ল্যাটিন আমেরিকা। এভাবেই বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা আসা-যাওয়া করেছে দুই মহাদেশের মধ্যে। এই দুই মহাদেশ ছাড়া অন্যদলগুলোর শিরোপা জয়ের ভাগ্য হয়নি। চ্যাম্পিয়ন হওয়া দূরের কথা, ফাইনালেই উঠতে পারেনি। বাইরের মহাদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সফল যে এশিয়া মহাদেশ, সেই মহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ২০০২ সালে সেমিফাইনালে উঠেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ঘরের মাঠে আয়োজিত বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে অবশ্য কোরিয়ানরা তুরস্কের কাছে হেরে গেছে ৩-২ গোলে।

২০০২ সালে ব্রাজিলের পর ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। অতীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ বিশ্বকাপটা যাওয়ার কথা ছিল ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনায়। কিন্তু ট্রফি গেল ইউরোপে। এবার বিস্ময়রূপে হাজির হলো মহাদেশটির নতুন পরাশক্তি স্পেন। স্প্যানিয়ার্ডদের এটাই প্রথম কোনো বিশ্বকাপ জয়। গোটা ফুটবল দুনিয়ার মোড়ক পাল্টে দিয়ে ক্যাসিয়াস-ইনিয়েস্তা-রামোস-পুয়োলরা ‘তিকিতাকা’র ফুটবল বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

অবশ্য বিশ্বকাপ আয়োজনের খুব একটা সুযোগও গত কয়েক দশক ধরে পাচ্ছেন না ল্যাটিন আমেরিকা। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার পর ল্যাটিন দল হিসেবে সবশেষ ব্রাজিল ২০১৪ সালে বিশ্বমঞ্চ সাজায় নিজেদের মাঠে। ২০তম বিশ্বকাপের আসর বসে ফুটবলের তীর্থভূমি ব্রাজিলে। ওই আসরে শিরোপা ল্যাটিন আমেরিকায় যাবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল। স্বাগতিক মহাদেশের দুই দেশ হিসেবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা উঠেছিল সেমিফাইনালে। পরের দলটি দীর্ঘ ২৮ বছর পর উঠেছিল স্বপ্নের ফাইনালে। কিন্তু জার্মানির কাছে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে হেরে যায় মেসিদের আর্জেন্টিনা। এই জার্মানরাই শেষ চারের ম্যাচে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে চূর্ণ করে গোটা বিশ্বকে বিস্ময় উপহার দিয়েছিল। সেই জার্মানিই হলো চ্যাম্পিয়ন। পরের বার অর্থাৎ গেল রোববার শেষ হওয়া বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট উঠল ফ্রান্সের মাথায়। আর তাতেই টানা ৪ বিশ্বকাপেই ইউরোপের বাজিমাত। এমনটা আগে কখনো ঘটেনি। ২০০৬ পর্যন্ত ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকার বিশ্বকাপ লড়াইয়ের ফল ছিল ৯-৯, সেখানে ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়াল ১২-৯!

তাতেই প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে। ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবলটা কি তবে শেষ হয়ে গেল? এবারের বিশ্বকাপে তো সেমিফাইনালে ওঠা চারটি দলের চারটিই ইউরোপের। দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা ১৬ দলের মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকান দল ছিল তিনটি। দুই আমেরিকা মিলিয়ে ধরলে কনকাকাফ অঞ্চলের দল মেক্সিকোকে ধরলে সংখ্যাটা চার। স্বাভাবিকভাবেই কথা উঠছে শুধুমাত্র ইউরোপে ফুটবলার সরবরাহ করার দেশ হয়ে উঠেছে ল্যাটিন আমেরিকার দলগুলো?

ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবল মানে সূক্ষè স্কিল, শিল্প, জালে বল জড়ানোর নিত্যনতুন উদ্ভাবনী রাস্তা খোঁজা, সর্বদা আক্রমণের রাস্তায় থাকা, ছক বা ফর্মেশনের কথা বেশি না ভেবে মনের আনন্দে ছন্দ তোলা ফুটবল। ইউরোপ আবার সাবধানী, সতর্ক। আগে ঘর সামলানো ও প্রতি আক্রমণ করার প্রবণতা তাদের। এ যাত্রায় ইতালি বড় উদাহরণ হতে পারে। ইংল্যান্ড ও জার্মানি অবশ্য এই ধারার কিছুটা বাইরের। গোলমুখে বল তুলে দেওয়া হয় স্ট্রাইকারের কাছে। মাঝ মাঠে বিল্ডআপ কম, বলকে ছোটানো বেশি, নিজেরা কম ছুটে। এর মধ্যে স্পেন আবার ‘তিকিতাকা’ নামক পাসিং স্টাইল বের করেছে। যার মূল কথা বল নিজের দখলে রাখা। দখল হারালে জলদি তা ফেরত আনা। যদিও বলের দখল রাখাই সবক্ষেত্রে জয়ের সরণিতে পৌঁছে দেয় না।

বরং ‘তিকিতাকা’র যুগ ২০১৪ বিশ্বকাপেই শেষ হয়ে গেছে। এগিয়ে থেকেও স্পেনকে বিধ্বস্ত হতে হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন স্পেনের ‘তিকিতাকা’র ছন্দ গুঁড়িয়ে দিয়েছে নেদারল্যান্ডস তুলে নিয়েছিল ৫-১ গোলের দুর্ধর্ষ জয়। এই ঘরনার ফুটবল যে এখন আর কার্যকর নয় সেটা সদ্য সমাপ্তি রাশিয়া বিশ্বকাপেও বোঝা গেছে। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে এই আসরে যে কয়টি বড় দল বিদায় নিয়েছে তাদের মধ্যে প্রায়সব দলই বেশিরভাগ সময় বল নিজেদের দখলে রেখে হেরেছে।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আবার সৃষ্টিশীল ফুটবলে বিশ্বাসী। নানা পথে ঢেউ তুলে গোলমুখ খোলাতেই আনন্দ। তবে সাধারণত কোনো না কোনো বড় তারকাকে কেন্দ্র করে আক্রমণ গড়ে ওঠে। পেলে-জিকো-ম্যারাডোনা-রোমারিও-রোনালদো থেকে মেসি-নেইমার পর্যন্ত ধারাটা চলে এসেছে। বড় তারকাদের একার কাঁধে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন শেষ বলেই মনে করা হচ্ছে। তাহলে কি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার আগামী দিনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরো কমছে? উত্তরের শঙ্কাটাও তো উঁকি দিচ্ছে।

ক্লাব ফুটবলে এই মুহূর্তে ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্যকেও বিশ্ব ফুটবলের সমীকরণ বদলে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। ল্যাটিন আমেরিকার একদা বিখ্যাত ক্লাবগুলোর দাপট কমে গিয়েছে অনেক। ব্রাজিলের সান্টোস, সাওপাওলো, করিন্থিয়ানস, ফ্ল্যামিঙ্গো, গ্রেমিওর জৌলুস ছিল আলাদা। আর্জেন্টিনায় রিভারপ্লেট, বোকা জুনিয়র্সও ছিল উজ্জ্বল। এখন সেটা নেই। বরং এখন দাপট চলছে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ। এককালে ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলান, ইন্টার মিলান ক্লাব ফুটবলের ছড়ি ঘুরিয়েছে বিশ্বব্যাপী।

কিন্তু ল্যাটিনদের মধ্যে কাপ জেতার মতো দল বলতে তো সেই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। তাও নীল-সাদা জার্সিধারীদের কাপ জয়ের ৩২ বছর বয়ে গেছে। উরুগুয়ে অনেক বছর ধরেই ট্রফি জয়ের দাবিদার নয়। শেষবার তারা বিশ্বকাপ জিতেছে ৬৮ বছর আগে। ২০০৬ সালে অবশ্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু ডিয়েগো ফোরলানের মতো বড় তারকাও দেশকে নিতে পারেননি ফাইনালে। এবার অবশ্য নতুন স্বপ্নে বিভোর ছিল উরুগুয়ে। কিন্তু এডিনসন কাভানি ও সুয়ারেজদের দেশ এই বিশ্বকাপে বিদায় নিয়েছে নকআউট পর্বের শুরুতেই। তবে উরুগুয়েকে নিয়ে খুব একটা প্রত্যাশা না থাকলেও ল্যাটিন আমেরিকার দল হিসেবে প্রত্যাশার চাপটা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ওপর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist