গাজী মো. রাসেল
ভুতুড়ে এক ফুটবল মহাযজ্ঞ
বিশ্বকাপের ২০তম আসরটি সবচেয়ে সফল ও স্মরণীয় আসর। ১৯৭৮ সালের পর আবার সোনালি বিশ্বকাপ যায় দক্ষিণ আমেরিকায়। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া ২০১৪ বিশ্বকাপকে দিয়েছিল নতুন মাত্রা। এই আসরটিকে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ট্র্যাজেডি বিশ্বকাপও বলা হয়। জার্মানির চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জয়। সুয়ারেজের আলোচিত কামড় কান্ড। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের ২০তম আসরটি স্মরণীয় হয়ে আছে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে।
৬৮ বছর পর বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় ফুটবলের তীর্থভূমি ‘দ্য সাম্বা কিং’ ব্রাজিল। এর আগে ১৯৫০ সালে শেষবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কেবল দুইটি দেশÑ ব্রাজিল ও কলম্বিয়া ইচ্ছা প্রকাশ করে। অবশ্য পরবর্তীতে আয়োজক দলের তালিকা থেকে কলম্বিয়া তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। তাতে ব্রাজিলই পায় বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব।
২০১৪ বিশ্বকাপে ফিফার মোট ২১০ সদস্যদের মধ্যে ২০৮ দল বাছাইপর্বে অংশ নেয়। বাকি দুই দলকে দুর্নীতির কারণে বাছাইপর্ব থেকে বিরত রাখে ফুটবল অভিভাবক সংস্থা ফিফা। এই আসরেও স্বাগতিক দল বাদে বাকি দলগুলো বাছাইপর্বে অংশ নিতে হয়েছিল। বাছাইপর্ব পার হয়ে যে দলগুলো মূলপর্বে অংশ নিয়েছিল ব্রাজিল (স্বাগতিক), আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে, আস্ট্রেলিয়া, ইরান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, ঘানা, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া, কোস্টারিকা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, রাশিয়া, স্পেন ও সুইজারল্যান্ড। ব্রাজিলের দৃষ্টিনন্দন ১২টি ভেন্যুতে বিশ্বকাপের মোট ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৪ বিশ্বকাপে চমক হিসেবে আসে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন স্পেন। গ্রুপপর্বে আগের আসরের রানার্সআপ নেদারল্যান্ডসও তাদের প্রতিশোধটা নিয়েছিল। স্পেনকে ৫-১ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় ক্রুইফের উত্তরসূরিরা। তারপর চিলির কাছে ২-০ গোলে পরাজয়ে গ্লানি নিয়ে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় চ্যাম্পিয়ন স্পেন। বিশ্বকাপে আরেক চমক নিয়ে এসেছিল অফ্রিকার দল আলজেরিয়া। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে যায় তারা। যদিও দ্বিতীয়পর্বে জার্মানির কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় মরুভূমির যোদ্ধাদের। ২০তম আসরের হট ফেভারিট হিসেবেই বিশ্বকাপ শুরু করে স্বাগতিক ব্রাজিল। গ্রুপপর্বে ব্রাজিল ছিল অপ্রতিরোধ্য। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার ম্যাচটি ব্রাজিলকে বেশ ভুগিয়েছে। যদিও ২-১ গোলে কলম্বিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল সেলেকাওরা। তবে কলম্বিয়ার যুদ্ধাংদেহী ফুটবলের বলি হয়েছিলেন ব্রাজিলের ফুটবল সেনসেশন নেইমার দ্য সিলভা জুনিয়র। ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান এই তারকা ফুটবলার। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় জার্মানি। তবে নেইমারের অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল ‘পেন্টা চ্যাম্পিয়নরা’। জার্মানির পাওয়ার ফুটবলের কাছে নেইমারবিহীন ব্রাজিলের ছান্দসিক ফুটবল ধরাশায়ী হয়। ৭-১ গোলের বড় ব্যবধানের হারের লজ্জার সাগরে ডুবতে হয় স্বাগতিকদের। কোটি কোটি ভক্তদের হৃদয় ভেঙে সেমিফাইনাল থেকে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয় সেলেকাওদের। টুর্নামেন্টের চর্তুথ সেরা দল হয় আয়োজকরা।
বিশ্বকাপের আরেক ল্যাটিন জায়ান্ট আর্জেন্টিনা। গ্রুপপর্বের থেকেই ‘টিক টক’ ফুটবলে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট পায় আর্জেন্টাইনরা। আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসির কাঁধে ভর করে সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় আলবিসিলেস্তারা। সেমিফাইনালে মেসিদের সামনে পড়ে আগের আসরের রানার্সআপ নেদারল্যান্ডস। ক্রুইফের উত্তরসূরিদের হারাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল মেসি নির্ভর আর্জেন্টিনার। টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষায় ডাচদের হারিয়ে ফাইনালে উঠে ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা।
বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও জার্মানি। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের ফাইনালের পর প্রত্যাবর্তন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মেসিরা। তবে গঞ্জালো হিগুয়েনের সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করলে নির্ধারিত সময়ের খেলা গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ে মরিও গোটসের একমাত্র গোলে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় জার্মানি। আর তীরে এসে তরি ডুবিয়ে বিশ্বকাপ অধরাই থেকে যায় ম্যারাডোনার উত্তরসূরিদের। বিশ্বকাপ না জিতলেও টুর্নামেন্ট সেরা গোল্ডেন বলের মালিক হন লিওনেল মেসি। আর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতে নেয় হামেস রদ্রিগেজ। আর জার্মান তরকা মিরোস্লাভ ক্লোসা বিশ্বকাপে সর্বমোট ১৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড গড়েন। আগে এই রেকর্ডটি ছিল ব্রজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদোর দখলে। তিনি করেছিলেন ১৫ গোল। তবে বিশ্বকাপে বেশ আলোচিত হয়েছিল গ্রুপপর্বে ইতালি ও উরুগুয়ের ম্যাচেটি। সেই ম্যাচে হঠাৎ ইতালির খেলোয়াড় জর্জিও কিয়েলিনির ঘাড়ে কামড় দিয়ে বসে উরুগুয়ের ফরোয়ার্ড লুইস সুয়ারেজ। কামড় কান্ডের দন্ড হিসেবে লালকার্ড দেখেন এই আলোচিত তারকা। নিষিদ্ধ হন ৯ ম্যাচের জন্য।
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, বিবিসি, ফিফাডটকম
"