গাজী মো. রাসেল
ছবি ও কবিতার দেশে নতুন শুরু
ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ১৯৯৮ সালের ষোড়শ বিশ্বকাপ চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ফুটবলপ্রেমীদের মনে। বৈশ্বিক আসরের মঞ্চ বসেছিল ছবি ও কবিতার দেশ ফ্রান্সে। যেখানে বসেছিল এক ঝাঁক কিংবদন্তির হাট। জিনেদিন জিদান, ডেবিড বেকহ্যাম, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার মতো বিশ্বমানের ফুটবলারদের মেলা বসেছিল ফ্রান্সে। এর বাইরে বরাবরের মতো ব্রাজিল তো ছিলই। দুঙ্গা, রবার্তো কার্লোস, রোনালদো, রিবালদো, বেবেতো, কাফুর মতো লিজেন্ডের ঠাসাঠাসি ছিল সেলেকাওদের স্কোয়াডে।
উরুগুয়ে মঞ্চায়ন হয়েছিল প্রথম ফুটবল মহাযজ্ঞের। ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় আসরটার আয়োজক ছিল ফ্রান্স। দীর্ঘ ছয় দশক পর বিশ্বকাপ প্রত্যাবর্তর ফ্রান্সে। তৃতীয় দল হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় ইউরোপের দেশটি। চেনা মঞ্চে আসরটা রীতিমতো ছাড়িয়ে গিয়েছিল ফরাসিদের স্বপ্নের সীমানাকে। ওই বিশ্বকাপে শুধু ভোটযুদ্ধ নয়, মাঠের যুদ্ধেও জিতেছিল ফ্রান্স।
বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার দৌড়ে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আফ্রিকার দেশ মরক্কো। জুরিখে ১৯ ভোটের যুদ্ধে ফরাসিরা বিজয়ী হয় ১২ ভোটে; মাত্র ৫ ভোটের ব্যবধানে। কিন্তু ভোটাভুটির প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক ছিল না। ২০১৫ সালে বিস্ফোরক এই তথ্যটাই ফাঁস করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। সুন্দর সমাপ্তির সেই আসরটা শেষ পর্যন্ত কলঙ্কের কালি মাখল ১৭ বছর পর। এফবিআই প্রমাণ করে আয়োজক দেশ হওয়ার ফিফাকে উপঢৌকন দিয়েছিল ফ্রান্স।
ওই বিতর্কটা বাদ দিলে ফ্রান্স বিশ্বকাপটা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অতীতের সব আয়োজনকে। এই আসর দিয়েই ২৪ দলের বিশ্বকাপের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে ফিফা। মূলপর্বের জন্য আরো ৮টি টিকিট সরবরাহ করে ফিফা। স্বাগতিক ফ্রান্স ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল বাদে ৩০টি টিকিটের জন্য বাছাইপর্বে লড়তে হয়েছিল ১৭৪টি দলকে!
১৬তম বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলো হচ্ছেÑ ফ্রান্স (স্বাগতিক), ব্রাজিল (চ্যাম্পিয়ন), আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, জ্যামাইকা, যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, ইরান, জাপান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, ক্যামেরুন, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তিউনিশিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, রোমানিয়া, স্কটল্যান্ড, স্পেন, যুগোসøাভিয়া ও প্যারাগুয়ে।
দলের সংখ্যা বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই নতুন আরো একটা ফরমেট চালু হয় এখান থেকে। ৩২টি দলকে চার ভাগে বিভক্ত করে তৈরি করা হয় আটটি গ্রুপ। গ্রুপের সেরা দুই দল টিকিট পায় নক-আউট পর্বের। ১৯৯৮ সালের ওই টুর্নামেন্টের ফরমেটটা এখনো চলছে বিশ্বকাপে। ফ্রান্সের ১০টি ভেন্যুতে বিশ্বকাপের সর্বমোট ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এই আসরে ল্যাটিন জায়ান্ট আর্জেন্টিনা ফেভারিট তালিকায় না থাকলেও গ্রুপ পর্বে উড়ন্ত সূচনা করে। প্রথম ম্যাচ জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার হ্যাটট্রিককে জ্যামাইকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল আলবিসেলেস্তেরা। কিন্তু আর্জেন্টাইনদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলো দ্বিতীয় রাউন্ডে; ইউরোপিয়ান পরাশক্তি ইংল্যান্ডের কাছে। যেখানে দুই ঘণ্টার লড়াইটা অমীমাংসিত থেকে যায় ২-২ ব্যবধানে। টাইব্রেকে জিতে এ যাত্রায় বেঁচে যায় দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। নেদারল্যান্ডসের কাছে ২-১ গোলে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ে মেসি-ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা।
তবে ল্যাটিন আরেক জায়ান্ট ব্রাজিল হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। তারকাঠাসা সেলেকাওদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি অন্য দলগুলো। যদিও গ্রুপপর্বে নরওয়ের কাছে পা হড়কাতে হয় ব্রাজিল। তবু গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই নকআউট পর্ব ওঠেন দুঙ্গা-কার্লোসরা। এরপর ব্রাজিল বিদায় করে চিলি, ডেনর্মাক ও নেদারল্যান্ডসকে। তবে শেষের দলটিকে হারাতে বেগ পেতে হয়ছিল ব্রাজিলকে। রোনালদোর একমাত্র গোলেই রক্ষা হয় সেলেকাওদের, নির্ধারিত সময় শেষে ডাচদের সঙ্গে ড্র করে তারা। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শ্যুট আউটে ব্রাজিলে হেসে খেলেই হারিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসকে। ৪-২ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় কমলা শিবির।
সেরা দুই দলই ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফাইনালের টিকিট পায়। তবে ফ্রান্সের সঙ্গে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ব্রাজিলকেই এগিয়ে রেখেছিল সবাই। কিন্তু দুর্দান্ত খেলা সেলেকাওদের ছন্দপতন ঘটল শেষ ম্যাচেই। প্রথমার্ধেই ম্যাচটা প্রায় শেষ করে দেন ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি জিদান। করেন জোড়া গোল। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি সেলেকাওরা। উল্টো ম্যাচের প্রান্তসামীয় ব্রাজিলের কফিনে শেষ পেড়েকটি ঠুকে দেন ইমানুয়েল পিত্তি। আর তাতেই প্রথমবারের মতো বহু অরাধ্যের ধন্য বিশ্বকাপের ট্রফি জেতে ফ্রান্স। বিশ্ব ফুটবলও পেয়ে গেছে নতুন রাজাদের।
ব্রাজিলের জন্য সান্ত¡না হয়ে এলো টুর্নামেন্টজুড়ে আলো ছড়ানো রোনালদোর গোল্ডেন বল জেতাটা। আর এর মাধ্যমেই বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি দিতে শুরু করে ফিফা। তবে গোল্ডেন বুট জিতেছে ডেভর শুকের। সর্বোচ্চ ছয় গোল করেছিলেন তিনি। এই ফরওয়ার্ডের আগুনঝরা পারফরম্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে অভিষেক বিশ্বকাপেই কাঁপিয়ে দেয় ক্রোয়েশিয়া। সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে যায় সেমিফাইনালে।
"