বিতর্কিত আসরে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা
গাজী মো. রাসেল
দীর্ঘ ১৬ বছর বিশ্বকাপ ফিরেছে ল্যাটিন আমেরিকায়। প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক আসরের আয়োজন করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু নিজেদের মহাদেশে ফুটবল মহাযজ্ঞ ফেরানোর উপলক্ষটা রাঙাতে পারেনি আর্জেন্টিনা ও ফিফা। ১৯৩৪ সালের পর আরো একটি বিতর্কিত বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিল তারা। ল্যাটিন দেশকে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব দিয়ে সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়েছিল বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা আইসিসি। কারণ দেশটিতে তখন চলছিল সামরিক শাসন।
আর্জেন্টিনায় বিশ্বমঞ্চ বসায় আসরটা শুরুর আগেই বয়কট করে অনেক দলই। গত আসরের ফাইনালিস্ট নেদারল্যান্ডসও বিশ্বকাপ বর্জনের হুমকি দিয়েছিল। যদিও জল অনেক দূর গড়ানোর পর অংশ নেয় ডাচ্রা। আর্জেন্টাইন সামরিক সরকার কূটনৈতিক তৎপরতায় দলগুলোকে আসরের দিকে নিয়ে আসে। বাছাই পর্বে অংশ নেয় দলগুলোও। এখানে রীতিমতো অঘটনের ছড়াছড়ি। ইংল্যান্ড, উরুগুয়ে, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া মতো বড় দলগুলো বাদ পড়ে বাছাই পর্বেই।
চমক হিসেবে বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট পেয়ে যায় এশিয়ান ও আফ্রিকান দুই দেশ ইরান ও তিউনিশিয়া। শেষ অবধি একাদশ আসরে অংশ নেওয়া দলগুলো হচ্ছেÑ আর্জেন্টিনা (স্বাগতিক), পশ্চিম জার্মানি (চ্যাম্পিয়ন), ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, স্পেন, সুইডেন, ইরান ও তিউনিশিয়া। এই ১৬টি দলকে আগের বিশ্বক্যাপের মতো গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে সেরা দুই দলকে নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আবার দুই গ্রুপে ভাগ করা হয়। পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয় গোলের মাধ্যমে।
তবে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে যায়। নেদারল্যান্ডস কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফের স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। স্ত্রীর অনুরোধ রাখতে গিয়ে শেষ অবধি বহুল আলোচিত বিশ্বকাপটা বর্জন করেন ডাচ্ কিংবদন্তি। ক্রুইফকে ছাড়াই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল নেদারল্যান্ডস। তিনি থাকল হয়তো স্বপ্নের শিরোপাটা ওই আসরে পেয়ে যেতে পারত কমলা শিবির।
বহু বছর চেষ্টা করার ফসল হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। ঘরের মাঠে সবচেয়ে ফেভারিটও ছিল তারা। মেনোত্তি সিজার লুইসের দলে ছিলেন মারিও কেম্পেসের মতো স্ট্রাইকার। ড্যানিয়েল প্যাসেরিলার নেতৃত্বাধীন দলে কেম্পেস ছাড়াও ছিলেন ওসভালদো আর্দিলেস, লিওপলদো লুকি, ওভাদো ফিললোলের মতো তারকা খেলোয়াড়। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় আর্জেন্টিনা কোচ মেনোত্তি দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন উদীয়মান তারকা ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে!
গ্রুপ পর্বে ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি সঙ্গে জিতলেও ইতালির কাছে হেরে গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা দল হয় আর্জেন্টিনা। আরেক ল্যাটিন জায়েন্ট ব্রাজিল গ্রুপ পর্বে এক জয় ও দুই ড্র নিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারা পড়ে যায় একই গ্রুপে!
দ্বিতীয় পর্বের প্রথম ম্যাচে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। তবে ব্রজিলের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করলে কঠিন এক সমীকরণর সামনে আসে লা আলবিসেলেস্তেদের। ফাইনালে উঠতে হলে গ্রুপের শেষ ম্যাচে দুর্দান্ত পেরুকে বিধ্বস্ত করতে হবে ৪-০ গোলে। এমন অগ্নিপরীক্ষার ম্যাচে পেরুভিয়ানদের ৬-০ গোলে চূর্ণ করে আর্জেন্টিনা। যদিও সেই ম্যাচ নিয়ে বিতর্কের শেষ ছিল না। অভিযোগ ওঠে ম্যাচটি পাতানো হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অভিযোগটা হাওয়ায় মিলে যায়।
অবশ্য ক্রুইফ না থাকলেও এই বিশ্বকাপের নেদারল্যান্ডস ছিল উজ্জ্বল। টোটাল ফুটবলের ওপর দাঁড়িয়ে টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে উঠে যায় ডাচ্ শিবির। কিন্তু বুয়েন্স এয়ার্সে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে পেরে ওঠেনি আধুনিক ফুটবলের জনকরা। তবে স্বপ্নভঙ্গ হলেও থ্রিলার একটা ম্যাচ উপহার দিয়েছিল ডাচ্রা।
ঘরের মাঠে আসরের শুরু থেকেই কেম্পেস ছিলেন ছিল দুরন্ত ফর্মে। কেম্পেস মাঠে নামবেন আর গোল করবেন এটা এক প্রকার নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ফাইনালে তার গোলে শুরুতে এগিয়েও গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ডাচ্ তারকা ডিক নান্নিনগা সমতায় ফেরান দলকে। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। ওই সময়েই আর্জেন্টিনার হয়ে আরেকটি গোল করেন কেম্পেস। তার সঙ্গে বেতোনির গোল। ৩-১ গোলে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। টানা দ্বিতীয়বার তীরে এসে তরি ডুবল নেদারল্যান্ডসের। তাদের স্বপ্নটা মূলত ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন কেম্পেস ফাইনালে দুই গোল করে। আসরে সর্বোচ্চ ৬ গোল করে গোল্ডেন বুটও জিতে নিয়েছেন আর্জেন্টাইন এই স্ট্রাইকার।
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপেই প্রথম অফিসিয়াল বলের নিয়ম করা হয়। প্রথম ‘টেঙ্গো’ নামের অফিসিয়াল বলটি তৈরি করে ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস। যা এখন পর্যন্ত বিখ্যাত হয়ে রয়েছে বিশ্ব ফুটবলে।
তথ্য সূত্র : ফিফাডটকম, গার্ডিয়ান, উইকিপিডিয়া
"