মুহাম্মদ কামাল হোসেন

  ১৮ নভেম্বর, ২০১৭

পাকনা বুড়ির ফোকলা হাসি

‘বুড়িগো বুড়ি, ও বুড়ি, যাবে কই- বাপের বাড়ি, খাবে কী- চিড়ে মুড়ি...।’ এগুলো বুড়িকে নিয়ে আমার বানানো ছড়া। অধিকাংশ সময় অর্থের দিকে নয়, ছন্দের দিকেই আমাকে ফোকাস রাখতে হয়। মাঝে মাঝে আমি কী বলি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু আমার বুড়িমা ঠিকই বোঝে। ছড়া শুনে আর হাসে। ফোকলা হাসি হাসে। হেসে কুটি কুটি হয়। ঘরময় তরঙ্গিত হয় বুড়ির হাসি। ছড়ার স্টক শেষ হয়ে গেলে রক্ষে নেই। বুড়ি তার ছোট্ট হাত দিয়ে খোঁচা মেরে বলে,

‘আব্বু থামলে কেন?’

তাগাদা খেয়ে আমাকে আবারো ছড়া কাটতে শুরু করতে হয়। ছড়ায় ছড়ায় বুড়িকে ঘুম পাড়িয়ে দিই। একসময় ঘুম এসে গেলে আমারও অযাচিত বক-বকানি থেমে যায়। সাময়িক ছুটি মেলে। তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। আমার বুড়িটা আবার খুব পাকনা। তাকে আমরা বুড়ি-মা বলেই ডাকি। রোজ রোজ আমাকে ওকে গোসল করাতে হয়, খাওয়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়। আরো কত কী। ঘুম থেকে জেগে ওঠে আমাকে না দেখলে, শুরু হয় বুড়ির কান্না। মায়া কান্না। তাকে আমি খুব ভালোবাসি। বুড়িটার সুন্দর একটা নামও রয়েছে-সাদিয়া মারজান। কিন্তু বুড়ি ডাকের আড়ালে তার আসল নামটা কিছুটা চাপা পড়ে গেছে। বুড়ি এখন ইশকুলে গেছে। প্লেতে পড়ে। ইদানীং ইশকুলে ওর চাহিদা অনেকটা বেড়েছে। অ্যাসেম্বলি শেষে ওকে সবাইকে ছড়া শেখাতে হয়। বুড়ি এ কাজটি খুব আনন্দ সহকারে করে। তাছাড়া একদিন পরেই ইশকুল থেকে বাচ্চাকাচ্চারা পতেঙ্গা শিক্ষাসফরে যাচ্ছে। তাই ক্লাসে পড়ালেখার চাপটাও কিছুটা কম। বুড়ি মায়ের সাথেই প্রতিদিন ইশকুলে যায়। মাঝে মাঝে আমিও নিয়ে যাই। সারাদিনের এই সময়টুকু বুড়ি মায়ের সাথে ইশকুলে থাকে। বাদবাকি সময় থাকে আমার সঙ্গে। মেয়েরা বাপের আদুরী হয়। গলায় গলায় ভাব রাখে। খুনসুটি করে। ওর মা আবার এসব আদিখ্যেতা একদম সহ্য করতে পারে না। ওল্টো আমাকে বলে,

‘তোমার আদর পেয়ে পেয়ে মেয়েটা আজ বাঁদর হয়ে যাচ্ছে, গোল্লায় যাচ্ছে।’

আমি তাকে বলি, ‘আজ গোল্লায় যাচ্ছে যাক, কাল তো যাচ্ছে না।’

‘কী বললে..!’

রেগে যায় বুড়ির মা। আমিও আর কথা বাড়াই না। মুখে তালা লাগাই। চুপ করে থাকি। সব কথার জবাব দিতে হয় না। দিতে গেলে ঝগড়া বাধে। চুপ থাকি। কিন্তু আমার স্ত্রী আরো রেগে যায়।

‘কী হলো, কথা বলছ না কেন?’

‘কী বলব বল? মেয়েকে একটু আদর করলে এমন কী হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়? একটাই তো মেয়ে আমাদের!’

‘মহাভারত!? মহাভারত কবে আর শুদ্ধ ছিল শুনি? এটার দোহাই দিয়ে দিয়ে আর কতদিন চলবে? আগামীকাল থেকে তুমি মেয়েকে ইশকুলে নিয়ে যাবে। আমি পারব না। সারাক্ষণ ইশকুলে আমাকে জ্বালিয়ে ছাড়ে। তুমি জানো ইশকুলে মেয়েটা কতটা দস্যিপনা করে?’

‘আহ হা! ছাড় না। এভাবে বলছো কেন। ছোট মানুষ। একআধটুকু দুষ্টুমি তো করবেই।’

‘আদুরী মেয়ের বাঁদুরী স্বভাব। নিজে যেমন, মেয়েকেও বানিয়েছে ঠিক তেমন। চিরকালই এক স্বভাবের। বাপকা বেটি!’

মায়ের কথা শুনে বুড়ি ফোকলা হাসে। হাতে তালি দেয়। বুড়ির দাঁতের চোয়ালে দু’তিনটি জানালা আছে। সবগুলো দাঁত এখনো ওঠার সুযোগ পায়নি। একটু হাসলে জানালার কপাটগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

‘কী মজা কী মজা! আব্বু আম্মু ঝগড়া করছে!!’

আমি আনমনে হেসে যাই। কথা বাড়াই না। একসাথে থাকলে সংসারে এসব হাঁড়ি-পাতিল টুকাটুকি ঠুকাঠুকি একটু হয়। এটাকে ঠিক ঝগড়া বলা যায় না। ঝগড়া বলতে নেই।

২.

বুড়ি এখনো মাকে নিয়ে স্কুলে রয়েছে। ফেরার সময় এখনো অনেক বাকি আছে। বুড়ির কণ্ঠ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ইশকুলে এসেম্বলি শেষে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বুড়ি ছড়া কাটছে। শিশুরা ওর সাথে তালে তাল মেলাচ্ছে। বুড়িগো বুড়ি ও বুড়ি...না না, এটা নয়। এটা আমার ছড়া। বুড়িকে ঘুম পাড়াতে কাজে লাগাই। বুড়ি মাইকে উচ্চস্বরে অন্য ছড়া কাটছে, ‘আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মউ।’ আধো আধো কণ্ঠে পাকনা বুড়িটা পুরো ছড়াটি সবাইকে পড়িয়ে ছাড়ল। ইশকুলে এসেম্বলি শেষে তাকেই বেশিরভাগ মাইকে ছড়া শেখাতে হয়। বাবা হিসেবে গর্ভে আমার বুক ভরে যায়। বুড়ি পড়ালেখায় বরাবর ভালো। বেশিক্ষণ বই-খাতা নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না। দু’একবার পড়লে পড়া মুখস্থ হয়ে যায়। ইশকুলের টিচাররা বুড়িতে রীতিমতো মুগ্ধ। সবাই তাকে আদর-স্নেহ করে। বুড়ির ফোকলা দাঁতের খিলখিল হাসি দুনিয়া জোড়া। মুহূর্তে মন ভালো হয়ে যায়। দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে জানান দিল ১১টা বেজে গেছে। আমাকে এক্ষুণি বুড়ির ইশকুলে যেতে হবে। ইশকুল থেকে সব শিশুদের নিয়ে পতেঙ্গা বেড়াতে যাবে। সঙ্গে শিশুদের পিতা-মাতারাও যাবে। কিছুটা সময় ওদেরকে নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটানো। আমরাও সাথে সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। বুড়ির সাথে আমরা দু’জনে যাব। ইশকুলের বেতন এরই মধ্যে মাসের শুরুতেই দেওয়া হয়ে গেছে। পিকনিকের ‘ফি’টা আজ তাড়াতাড়ি দিতে পারলেই বাঁচি। সময়ও একদম নেই। রাত পোহালেই পিকনিক।

৩.

সকাল ১০টায় গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি ছুটে যাচ্ছে মাইকে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে পতেঙ্গা সৈকতের উদ্দেশে। যেখানে নদী ও সমুদ্রের সুন্দর মিলন ঘটেছে। প্রতিদিন নিয়মমাফিক এখানে সূর্য ডুবে অস্তরাগের সৌন্দর্য ছড়িয়ে। ভাড়া করা বড় দুটি বাস একযোগে চলছে। বুড়িকে নিয়ে আমরা একটাতে বসেছি। জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখে অবাক হয় বুড়ি। ঘরবাড়ি, গাছপালা ও বিস্তৃত ফসলের মাঠ অবাক অবাক চোখে দেখে। তার চোখে-মুখে মুগ্ধতার আলোটুকু ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। বিপুলা পৃথিবীর নয়নাভিরাম রূপ-সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে। অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনার আগ্রহ শিশুদের বরাবরই বেশি। বুড়ি উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে আমাকে এটা-ওটা দেখাচ্ছে। আমিও বুড়িকে প্রবোধ দিয়ে যাচ্ছি। ওর খুশির অন্ত নেই। বুড়ির মায়ের সেদিকে কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। সে সিটে হেলান দিয়ে ঝিম ধরে আছে। মাইকের ক্রমাগত উচ্চস্বর তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। মাথায় ধরে গেছে। বুড়ির মুহুর্মুহু চপলতা ও উচ্ছ্বাস তার চোখে পড়ছে না। হঠাৎ বুড়ি চেঁচিয়ে ওঠে।

‘দ্যাখ আব্বু গাছপালা, বাড়িঘর ও বিদ্যুতের বড় বড় খুঁটিগুলো কীভাবে গাড়ির পেছনের দিকে দ্রুত দৌড়াচ্ছে!’

‘ওম্মা তাইতো!!’

আমি বুড়ির উচ্ছ্বাসটাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিই। সে চোখ বড় করে অবাক হয়ে এসব দেখে। মাঝে মাঝে হাসে। থরে থরে সাজানো অচেনা পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্যে ক্রমাগত বিমোহিত হয়। এদিকে বুড়ির ডাক পড়েছে মাইকে ছড়া আবৃত্তি করার জন্য। একজন ইশকুল ম্যাডাম বুড়িকে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়েছে। বুড়ি একে একে ছড়া আবৃত্তি শুরু করল। শিশুদের হর্ষধ্বনি ও হৈ-হুল্লোড় ক্রমে বেড়ে যায়। বুড়ির উচ্ছ্বাসভরা হাসি ধরে না। বাঁধভাঙা হাসি উপছে উপছে পড়ে। আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে সে টানা

খিলখিলিয়ে হাসে। বুড়ির ছন্দময় ফোকলা হাসি মাইকে অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়। সেই হাসি ছুঁয়ে যায় ঘোর লাগা আমার আবেশিত হৃদয়কে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist