রুনা তাসমিনা

  ১১ নভেম্বর, ২০১৭

নীল ধ্রুবতারা

ঝনঝন শব্দে কাঁচের প্লেটটি কয়েকশ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ঘরের মেঝেতে ভাতসহ। কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে ফুলে ওঠা করুণ চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো সৈকত। রাগে জ্বলছে সেই মুখ। ইচ্ছে মতো মারার পরও রাগ কমেনি। সেই দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে অসহায় চোখে তাকালো মায়ের দিকে। গম্ভীরমুখে ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো তুলছে মা। অসাবধানতায় ভাঙা কাঁচের টুকরোতে হাত কেটে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্ত! মারের ব্যথা ভুলে গিয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে মায়ের হাতের আঙুলের রক্ত মুছিয়ে দিতে যেতেই মা তাকে হাত লাগাতে দিল না। অপরাধীর মতো সৈকত দাঁড়িয়ে রইল মায়ের পাশে। বাবা-মায়ের এই আচরণ একটুও পছন্দ হচ্ছে না নদীর। প্রতিবেশী কে কী বললো তা নিয়ে ঘরে তুলকালাম কান্ড! কিন্তু এখন কিছুই বলা যাবে না কাউকে, তাই ভাইকে টেনে নিয়ে এলো নিজের কামরায়। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছে সে এখন। ভাইটির জন্য খুব মায়া হয়। বাবার এলোপাতাড়ি মারে ঠোঁট ফেটে গিয়ে রক্ত শুকিয়ে আছে। ফর্সা মুখে হাতের আঙুলের ছাপ লালচে হয়ে বসে আছে। ওড়নার একপ্রান্ত ভিজিয়ে এনে ঠোঁটগুলো মুছিয়ে দিতে যেতেই সৈকত চাপাস্বরে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরে বোনকে। নদীর মনে হয় এতক্ষণে তার ছোট ভাইটি কোনো অবলম্বন পেল, যার কাছে তার কষ্ট চোখের পানিতে ঝরে পড়ছে-

আপু, বিশ্বাস কর! আমি ফেল করার মতো পরীক্ষা দেইনি!

সৈকত না বললেও নদী তা বিশ্বাস করে। সে জানে তার গানপাগল ছোট ভাইটি পরীক্ষার বেশ কয়েক মাস আগে থেকে পড়ালেখায় এত মনোযোগী হয়েছিল যে, প্রাণপ্রিয় গিটারটি ছুঁয়েও দেখেনি! যেটিতে একটি বালির কণাও পড়তে দেয়নি কখনো, সেই গিটারের ওপর ধুলোর আস্তর পড়লেও সেদিকে তাকায়নি। দেখেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার অনুরোধে আসা ফোন কল কেটে দিতে, কোন কোন সময় বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে দিত। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠে তারা। ছোট এই বাসার একটিতে বাবা-মা, অন্যটিতে দুই ভাই-বোন। কামরার দু’পাশে দুটি বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলটিতেই দু’জনের বইপত্র রাখা। পড়ালেখা এই টেবিলেই। এসএসসিতে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাস করে কলেজে আসার পর থেকে সৈকত গানের দিকে ঝুঁকে পড়ে বেশি। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ছোটখাটো পরিসরে বেশ কিছুটা পরিচিতিও হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার এনেছে বেশ কয়েকটি। বাবা এসব পছন্দ করে না। ছেলে ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার হবে-এটাই তিনি চান। তাই পুরস্কারটি প্রকাশ্যে হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকার সাহস পেত না। রুমে এসেই পেপার মোড়ানো ক্রেস্টটি বের করে বলত-

এই আপু দেখ, তোর ভাই কত জিনিয়াস! প্রথম পুরস্কার পেয়েছি! অনেকটা ফিসফিসিয়ে আনন্দমিশ্রিত গলায় নদী বলে, তাই! দেখিতো! দেখিতো!

ভাইয়ের প্রাপ্তিতে আনন্দ নদীরও। নদী ভালো করে দেখার আগেই চালান হয়ে যেত বিছানার নিচে রাখা বাক্সটিতে। গুপ্তধনের মতোই যেখানে যতœ করে রাখা আছে তার সব পুরস্কার! বাবার চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই, তাই এই গোপনীয়তা। ফয়’স লেকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের ছবিতে কিভাবে যেন সৈকতের ছবি পত্রিকায় চলে এসেছিল! বাবার চোখ গিয়ে পড়ল একেবারে সেই পাতাতেই! রাতে পড়ার টেবিলে সৈকতের সামনে পত্রিকাটি ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল- এগুলোর প্রভাব যেন পরীক্ষায় না পড়ে, কথাটি মনে রেখো সৈকত, এভাবে সিরিয়াস হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

পেপারে নিজের ছবি দেখে অভিভূত সৈকত। আনন্দের হাসি মুখে ছড়িয়ে রয়েছে। পেপারে চোখ রেখেই বলল-

আপু, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া কি খুব জরুরি? সঙ্গীত শিল্পী হলে কী হয়?

তাহলে ওই যে দরজা দেখছ-ওই দরজা দিয়ে এ বাড়িতে তোমার প্রবেশ নিষিদ্ধ হবে হেসে উঠল দুজনই। না রে! ওই দরজা, এই ছোট ঘরটি আমার সবচেয়ে প্রিয়! এই ঘরের মানুষগুলোর খুশির কাছে আমার সব ইচ্ছে হেরে যায়। আমি পড়ব, বাবার ইচ্ছে পূরণ করব।

সৈকত বোনকে দেওয়া কথা রেখেছে। সেকেন্ড ইয়ারের পড়া শুরু হতেই নতুন এক সৈকতকে দেখে নদী! এখন তার ব্যস্ততা বাড়ে স্যারদের বাসায়, কোচিংয়ে যাওয়া নিয়ে। মায়ের বদলে বাবা যখন দুধের গ্লাসটি নিয়ে সৈকতের পড়ার টেবিলে রাখে, নদী বুঝতে পারে বাবার মন এখন বেশ খুশি। এই ঘরের এটি একটি নিয়ম! যখন কেউ বড় কোনো পরীক্ষা দেবে তাকে প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খেতে দেওয়া হয়। নদীর এসএসসি পরীক্ষার সময় এই ব্যাপার নিয়ে সৈকত তুলকালাম কান্ড বাধিয়েছিল! দুধের গ্লাস পড়ার টেবিলে নদীর সামনে রাখতেই পাশে বসা সৈকত হাতের থাবায় দুধসহ গ্লাসটি ফেলে দিয়েছিল টেবিল থেকে! সাথে সাথে মা থাপ্পড় লাগিয়েছিল সৈকতের গালে!

এটা কী করলি? কেন ফেলে দিলি দুধের গ্লাস?

দেব না! তোমরা ওকে বেশি আদর করছ আমি কি বুঝি না? কাঁদতে কাঁদতে সৈকতের অভিযোগ মায়ের কাছে। হ্যাঁ, বেশি আদর করি।

কাঁচের টুকরোগুলো তুলে নিতে নিতে লুকিয়ে শাড়ির আঁচলে মায়ের চোখ মোছা নদীর চোখে ঠিকই ধরা পড়ে। গ্লাস ভাঙার শব্দে বাবাও এসে দাঁড়িয়েছে রুমের দরজায়। বাবার মুখটি ছিল অপারগতার ব্যথায়, কষ্টে মলিন। কাপড়ের দোকানের ম্যানেজারি করে বাবা যে টাকা পায়, তাতে পুরু মাসের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। তবুও ওদের পড়ালেখা করার জন্যে যা দরকার, যেমন করেই পারে ব্যবস্থা করেছে। সেদিন সৈকতকে নদী বুঝিয়েছিল মধ্যবিত্ত পরিবার কী! মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা কী চায়! পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড সাইন করতে গিয়ে বাবার মুখ কেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! কেন সেদিন মা অন্যদিনের চাইতে একটু আলাদা রান্না করে! সৈকতের পরিবর্তন দেখে নদী বুঝতে পারে-তার আদরের এই ভাইটি অতটা চঞ্চল নয়, যতটা বাইরে দেখে মনে হয়! ছোট হলেও সেদিন সে আপুর কথা বুঝেছিল। তবুও কেন এই অঘটন ঘটল! সর্বোচ্চ মেধা তালিকায় না এলেও এর নিচের অবস্থানে হলেও তো থাকার কথা! নদীর মনে হচ্ছে সব ভুল! সে কোনো স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন ছুটে গেলেই সব আগের মতো হাসি-খুশি হয়ে উঠবে! সকাল থেকে রেজাল্টের টেনশন আর রেজাল্ট আসার পর ঘরের এই অবস্থায় কিছুই পড়েনি আদরের ছোট ভাইটির পেটে। মাথায় ছোট্ট একটি চুমু খেয়ে রান্না ঘরের দিকে যায় চা করে আনতে।

নদী বেরিয়ে যেতেই সৈকত এসে দাঁড়ায় জানালার পাশে। বাবার ক্রোধের হাত থেকে রেহাই পায়নি তার গিটারটিও! বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনে মাঝখানে পড়ে আছে ভাঙা, মৃত অবস্থায়। সৈকতের হাতের ছোঁয়ায় যে তারগুলো গিটারে সুর তুলতো, সেই সুর তোলা তারগুলো ছিঁড়ে পড়ে আছে এদিক সেদিক! বুকটা মুচড়ে ওঠে। চোখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে। আবছা অন্ধকারে ধ্রুবতারাটি বেশ উজ্জ্বল, একটি দুটি করে ফুটে উঠছে আরো। কতগুলো পাখি ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়। শিল্পীমন তার মুহূর্তে ওই পাখিদের দলে মিশে যায়। আচ্ছা পাখিরা কি আকাশ ছুঁতে পারে? ওরা কি তারাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়? সবাই বলে মানুষ মৃত্যুর পর আকাশে তারা হয়ে জ্বলে! সত্যি কি তাই? তারারা কি নিচের পৃথিবীর সবকিছু দেখে! প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে মন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।

এই ঘরটিতে কখনোই উচ্চৈস্বরে কথা বলার নিয়ম ছিল না। আজ ক’দিন ধরে আরো বেশি নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে আর কথা বলে না। ফোনের শব্দটি তাই কারো তীক্ষè চিৎকারের মতো মনে হয়। বাবা বিছানা থেকে শ্লথ পায়ে নেমে এসে রিসিভ করে। ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে লাউড স্পিকার অন করে নদীকে দেয় কথা বলার জন্য। ও-প্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করলো, সৈকত কোথায়? কথা শুনে নদী একটু থমকে যায়। পরক্ষণে কী ভেবে সেও একই ভাষায় নিজের পরিচয় দিয়ে সৈকতকে কী দরকার জানতে চাইলে, তাকে অভিনন্দন জানিয়ে ওপাশের কণ্ঠস্বর বললো, ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া স্কুল অব মিউজিক’ সম্পূর্ণ স্কলারশিপ দিচ্ছে সৈকতকে তাদের ছাত্র হিসেবে! নদীর হাত-পা কাঁপছে! বুঝতে পারছে না কী বলবে! কোনরকমে প্রশ্ন করলো, স্কলারশিপ! কখন আবেদন করল সে! ফয়’স লেকের একটি কনসার্টে আমাদের প্রতিনিধি তার গানে মুগ্ধ হয়ে ভিডিওসহ রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিল। সিলেক্ট হওয়ার পর বাকি তথ্যগুলো আমরাই জোগাড় করে নিয়েছি। নদীর সাথে আর কথা বলতে চায় না ওরা। চমক দেওয়ার জন্য সৈকতকেই খোঁজে।

নদীর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতেই চাইছে না। আধভাঙা গলায় সে বলে, সৈকত তো স্টার হয়ে গেছে। অনেক বড় স্টার! অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছে সে!

কিছুটা বিস্ময়ের সাথে ওদিক থেকে ভেসে আসে-তার সাথে কথা বলতে চাই! ফোনটা দেওয়া যাবে?

আপনাদের দেশে কি আকাশ দেখা যায়? যদি দেখা যায় তাকিয়ে দেখেন! সৈকতকে দেখতে পাবেন! যে তারাটি সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করে! ও-ই সৈকত! কথা বলেন!

আচমকা নদীর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বাবা চিৎকার করে বলে ওঠে, বুঝেছেন! ওই তারা আমার সৈকত! আমার ছেলে আকাশের মুখ উজ্জ্বল করেছে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist