আহাদ আলী মোল্লা
আফসানার মাটির ব্যাংক
আফসানার মাটির ব্যাংকে বেশ টাকা জমেছে। প্রতিদিন আব্বুর দেওয়া টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সে ব্যাংকে জমা রাখে। তিন মাস আগে আব্বুকে দিয়ে ব্যাংকটি কিনিয়ে এনেছে আফসানা। ঈদের দিন নানু ভাই ওকে ৫০ টাকার একটা কচকচে নোট দিয়েছিলেন। চটজলদি সেটা ঢুকিয়ে ফেলল ব্যাংকে। এমনিভাবে কাকু, মামা, ভাইয়া কিংবা আম্মু কোনো টাকা দিলেই সে ব্যাংকে রাখে। মাঝে মাঝে ব্যাংকটি নেড়ে নেড়ে দেখে। হাতে তুলে ওজন করে। আন্দাজ করে কত টাকা হলো।
আগে আফসানা স্কুলে গেলেই আচার, চুইংগাম, চকলেট, আইসক্রিম আর চালতা খেত। কিন্তু ইদানীং সে ওসব খায় না। বলে ওসব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পেটে অসুখ হয়। স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তাই ওইসব খাওয়ার টাকা জমায় সে। এখন শুধু তার ঝোঁক টাকা জমানো। টাকা বাঁচানোর জন্য কোনো কোনো দিন স্কুল থেকে হেঁটেও আসে। আম্মু হাসেন। পাগলি মেয়ে হেঁটে আসতে কষ্ট হয় না?
‘কষ্ট কিসের। আরো ব্যায়াম হয়। মাঝে মাঝে হাঁটা ভালো। এতে শরীর ভালো থাকে।’ উল্টো সে বোঝায় মাকে। আফসানা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। সে চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। যেমনি বুদ্ধিমতী, তেমনি লক্ষ্মী মেয়ে। ক্লাসেও প্রথম। একবারও দ্বিতীয় হয়নি আফসানা। এ কারণে সবাই তাকে আদর করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও খুব ভালোবাসেন। পড়াশোনার কথা বলতে হয় না। একা একাই স্কুলের পড়া তৈরি করে।
ওরা গরিব মানুষ। বাবা চুয়াডাঙ্গার বঙ্গজ বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। সামান্য বেতন। মা নকশিকাঁথা সেলাই করেন। বাড়ি থেকেই তা বিক্রি দেন। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। এসব বোঝে আফসানা। ঈদ এলে সংসারের অভাব নিয়ে যখন মা-বাবার কথা হয়, তখন তা বোঝার চেষ্টা করে আফসানা। তাই গত রোজার ঈদের পর থেকে আফসানা বদলে যায়। সে ভাবে আমি যদি কিছু টাকা বাঁচাতে পারি তাহলে বাবা-মায়ের কষ্ট কমে যাবে। তাই সে মনে মনে ব্যাংকে টাকা জমানোর চিন্তা করে। আফসানা ভাবে পুরো বছর টাকা জমালে নিশ্চয় তা দিয়ে আমার পোশাক-আশাক কেনা হয়ে যাবে। ঈদে বাড়তি টাকা লাগবে না বাবার।
কিন্তু সেদিন স্কুলে গিয়ে সব হিসাব পাল্টে যায় আফসানার। একটি ব্যানার দেখে ওর মনটা কেঁদে ওঠে। লেখা আছে ‘এখানে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সাহায্য জমা নেওয়া হয়’। বন্যায় মানুষের যে কী কষ্ট তা সে টেলিভিশনে দেখেছে। তার মতো অনেক শিশু খাবার পাচ্ছে না। ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ওদের জন্য খুব ব্যথা পায় আফসানা। সে সিদ্ধান্ত নেয় মাটির ব্যাংক ভাঙার। ওতে যা টাকা আছে সব বন্যাদুর্গতদের জন্য সে দিয়ে দেবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে সিদ্ধান্তের কথা জানায় আফসানা। ওর কথা শুনে মা হাসেন। বাধা দেন না। বরং তিনি বলেন, এটা খুব ভালো কাজ মা। তুই ব্যাংকের টাকাগুলো নিয়ে ওখানে দিয়ে আয়। বিকেলে চৌকির তলা থেকে মাটির ব্যাংকটি বের করে আফসানা। ভাঙতে খুব মায়া হয় ওর। তাও সে আস্তে করে
আছাড় দিয়ে ব্যাংকটি ভাঙে। কয়েনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আম্মু এগিয়ে
আসেন। দুজন মিলে টাকাগুলো গোনেন। ৩৯৫ টাকা হয়। আম্মু একটা কাগজে
মুড়িয়ে এক টুকরো কাপড় দিয়ে
টাকাগুলো বেঁধে দেন। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে সাহায্য গ্রহণকারীদের হাতে ওই টাকাগুলো তুলে দেয় আফসানা। ওর সঙ্গে থাকা সহপাঠীরা ওর কাছ থেকে সব শোনে। তাদের মনও কোমল হয়ে ওঠে। তারাও সিদ্ধান্ত নেয় আফসানার মতো যে যা পারে বানভাসি মানুষের জন্য সাহায্য করবে। কারণ মানুষ তো মানুষের জন্য।
"