আব্দুস সালাম

  ২১ অক্টোবর, ২০১৭

গোপিনপুরের জঙ্গলে

অনেক দিন আগের কথা। একটি জঙ্গলের নাম ছিল গোপিনপুর জঙ্গল। জঙ্গলটি বেশ বড় ছিল। জঙ্গলে ভয়ংকর কোনো পশুপাখি বাস করত না। ওই জঙ্গলে একজন বৃদ্ধাও বাস করত। সে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজে সবুজডেরা গ্রামে আসত এবং কাজ শেষে আবার জঙ্গলে ফিরে যেত। গোপিনপুর জঙ্গলের একপ্রান্তে সবুজডেরা গ্রাম আর অন্যপ্রান্তে ছিল গুপ্তনগর গ্রাম। সবুজডেরা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। এ গ্রামের অধিবাসীরা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করত। আর গুপ্তনগর গ্রামটি ছিল অজপাড়াগাঁ। এখানে কেউ বাস করত না বললেই চলে। তবে ওই গ্রামে একদল ডাকাত বাস করত। ডাকাতরা কখনো দিনের বেলায় চলাফেরা করত না। ডাকাত দলের সর্দার খুব দুর্ধর্ষ ছিল। তুচ্ছ কারণে কাউকে হত্যা করতে সে দ্বিধা করত না।

সবুজডেরার অধিবাসীরা বেশ সচ্ছল ছিল। গ্রামের মজিদ মাতবর ছিল অনেক ধন-সম্পদের মালিক। ডাকাতদের অনেক দিনের লক্ষ্য ছিল মজিদের বাড়িতে ডাকাতি করা। কিন্তু তারা ডাকাতি করার কোনো সাহস পেত না। কারণ মজিদের বাড়িটা সবসময় প্রহরীরা পাহারা দিত। তারা যেমন সাহসী ছিল তেমনি অস্ত্র চালনায় পারদর্শীও ছিল। একদিন গভীর রাতে ডাকাতরা মজিদ মাতবরের বাড়িতে আক্রমণ করল। প্রহরীরা তখন সশস্ত্র অবস্থায় বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল। তারা ডাকাতদের গতিবিধি টের পেয়ে গেল। ডাকাতদের শায়েস্তা করার জন্য প্রহরীরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরীদের আক্রমণে একজন ডাকাত প্রাণ হারাল। ডাকাত সর্দার গুরুতর আহত হলো আর অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। ডাকাতের সর্দার আহত হওয়ার কারণে দ্রুত পালাতে পারল না। কোনো উপায় না দেখে প্রাণ বাঁচাতে সে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিল।

সর্দারকে দেখতে না পেয়ে অন্য ডাকাতরা ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবল সর্দার যদি ধরা না পড়ে বা প্রাণে বেঁচে থাকে তাহলে আমাদের আর রক্ষা নেই। সে আমাদের সবাইকে হত্যা করবে। তাদের গুপ্তনগরে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল। ডাকাত সর্দারও আর জঙ্গল থেকে বের হতে পারল না। সে জঙ্গলেই রয়ে গেল। আহত হওয়ায় সর্দারের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জঙ্গলে বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অবশেষে একটা গাছের নিচে সে শুয়ে পড়ল। সে যন্ত্রণায় কাতর ছিল। সে আস্তে আস্তে বেশ দুর্বল হয়ে গেল। তার শারীরিক অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন হলো যে, তার বেঁচে থাকার আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ঠিক সেই সময় জঙ্গলের বৃদ্ধা গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। কিছুদূর আসার পর সে ওই ডাকাত সর্দারকে দেখতে পেল। জঙ্গলের ভিতর একাকী কোনো লোককে গাছের নিচে শুয়ে থাকতে দেখে সে খুব অবাক হলো। বৃদ্ধা সর্দারের কাছে গিয়ে দেখল যে, সে ভীষণ অসুস্থ, অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। সে বুঝতে পারল যে, সে কোনো দুষ্ট প্রকৃতির লোক হবে। যে কি না প্রাণের ভয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তবুও বৃদ্ধা তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল এবং সেবাশুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তুলল।

ডাকাত সর্দার সুস্থ হয়ে গেলে বৃদ্ধার সঙ্গে তার পরিচয় হলো। সে কেন জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে তার ঘটনা সে বৃদ্ধাকে বর্ণনা করল। সব ঘটনা শুনে বৃদ্ধা তাকে বলল, ডাকাতি করা একটি ঘৃণ্য কাজ। জঘন্য অপরাধ। যা সমাজে অশান্তি বয়ে আনে। চোর-ডাকাতরা সমাজের ঘৃণার পাত্র। সমাজে তাদের কোনো মানমর্যাদা নেই। তাদের কেউ ভালো চোখে দেখে না। কেউ ভালোবাসে না। তাই এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত। বৃদ্ধার কথা শুনে ডাকাত সর্দারের বোধোদয় হলো। তার কৃতকর্মের জন্য সে লজ্জিত হলো। সে বৃদ্ধার কাছে প্রতিজ্ঞা করে বলল যে, আমি আর কখনো ডাকাতি করব না। এখন থেকে সৎভাবে জীবনযাপন করব। শুধু তা-ই নয়। আমার অন্য সঙ্গীদেরও সৎভাবে জীবনযাপন করার জন্য পরামর্শ দেব। সর্দারের কথা শুনে বৃদ্ধা তার প্রতি খুশি হলো। বৃদ্ধা তাকে বলল, আমি তোমাদের সৎভাবে জীবনযাপন করার জন্য সহযোগিতা করব। তুমি আজ রাতেই বাড়ি চলে যাও। আর একটা অনুরোধ রইল- আমার কথা তুমি কাউকে বলবে না। যদি সম্ভব হয় এক মাস পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। সাবধান ! সঙ্গে যেন কেউ না আসে!

ডাকাত সর্দার বাড়িতে ফিরে গেল। বেশ কয়েক দিন পর তাকে জীবিত অবস্থায় দেখে অন্য ডাকাতরা ভয় পেয়ে গেল। তারা সর্দারের কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইল। সর্দার তাদের বলল, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। আর একটা কথা শুনে রাখ। আমি আর কখনো ডাকাতি করব না। এসব ঘৃণ্য কাজ তোমরাও ছেড়ে দাও। তারাও সর্দারের নিকট ডাকাতি না করার প্রতিশ্রুতি দিল। অবশ্য পরবর্তীতে তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছিল। তাই কিছুদিন পরে তারা আবার আগের মতো ডাকাতি করা শুরু করল। ওদিকে এক মাস পর সর্দার বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে জঙ্গলে প্রবেশ করল। সর্দার ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছে শুনে বৃদ্ধা তার প্রতি খুশি হলো। সে তাকে বলল, আমি খুব অসুস্থ। হয়তো আর বাঁচব না। তুমি দেখা করতে এসে ভালোই করেছ। আজ তোমাকে একটি গোপন কথা বলব। কথাটি তুমি ছাড়া আর কেউ যেন না জানে। বৃদ্ধা বলল, এই ঘরের মাটির নিচে একটা ছোট্ট তামার হাঁড়ি রয়েছে। সেই হাঁড়িতে রয়েছে গুপ্তধন। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ গুপ্তধন আগলে রেখেছি। ভাবছিলাম কাউকে উপহার হিসেবে এটি দিয়ে যাব। কিন্তু উপহার দেওয়ার মতো কাউকে এ পর্যন্ত পাইনি। আজ তোমাকে পেলাম। তুমি এ উপহার পাওয়ার যোগ্য। আমার মৃত্যুর পর গুপ্তধনগুলো তুমি ভোগ করবে। আর এ গুপ্তধন থেকে কিছু খরচ করবে তোমার অন্য ডাকাত সঙ্গীদের জন্য। তুমি তাদের সাহায্য করলে দেখবে তারাও আর ডাকাতি করবে না। আলোর পথে ফিরে আসবে।

পরদিন সকালবেলায় সর্দার গুপ্তনগরে ফিরে এলো। কিছুদিন পরই ডাকাত সর্দার জানতে পারল যে, সবুজডেরায় ওই বৃদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুর সংবাদ শুনে সর্দার খুব কষ্ট পেল। বৃদ্ধার কথা মতো সে একদিন জঙ্গলে প্রবেশ করল। বৃদ্ধার ঘরের মেঝে খুঁড়ে সেই গুপ্তধনের

হাঁড়িটি আবিষ্কার করল। হাঁড়িটি সোনাদানায় পরিপূর্ণ ছিল। তারপর খুব গোপনে সে হাঁড়িটি বাড়িতে নিয়ে এলো। গুপ্তধনের মাধ্যমে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটল। সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। আর ওই গুপ্তধনের কিছু অংশ তার পূর্বের ডাকাত সঙ্গীদের জন্য খরচ করল। সর্দারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে তারাও সত্যি সত্যি ডাকাতি করা ছেড়ে দিল। একদিন তারা সকলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। তারপর থেকে তারা কখনো আর ডাকাতি করেনি। ফলে আশপাশের গ্রামবাসীরাও নির্ভয়ে সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist