আরাফাত শাহীন

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সোনাব্যাঙের বিয়ে

সোনাগাছি গাঁয়ে বিরাট একটি ডোবা ছিল। সেই ডোবায় বাস করত মিয়াং নামে এক সোনাব্যাঙ। মিয়াং ছিল এই ডোবার রাজা। সে ছিল বদমেজাজি এবং স্বেচ্ছাচারী। কারো কোনো মতামত সে শুনত না। মিয়াংয়ের সেনাপতি কং ছিল ভারী দুষ্ট বুদ্ধির অধিকারী। মিয়াং শুধুমাত্র কং-এর কথাই শুনত এবং মেনে চলত। ফলে ডোবার অন্যান্য ব্যাঙ প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে মিয়াং-এর ওপর চটে ছিল। হঠাৎ করেই মিয়াং-এর বিয়ে করবার খায়েশ জাগল। একদিন ডোবার সমস্ত ব্যাঙকে সে ডোবার ধারে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিতে আসতে বলল। ব্যাঙ সমাজের কোনোপ্রকার সভা-সমাবেশ কিংবা মিটিং করার দরকার হলে সবাই এখানে এসেই মিলিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই জায়গামত উপস্থিত হয়ে মিয়াংকে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিতে দেখতে পেল। কোনো ঘোষণা দেওয়ার দরকার হলে মিয়াং সাধারণত ওই জায়গাটিতেই উপবেশন করে থাকে। উপস্থিত সকলের মাঝে একটা কানাঘুষা আরম্ভ হয়ে গেল। সবাই মিয়াং-এর আসন্ন বক্তব্য নিয়ে নিজের মতো করে বলতে আরম্ভ করল। সবার ফিসফিসানি ছাপিয়ে একসময় মিয়াং-এর দরাজ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি বহুদিন ধরে এই ব্যাঙ সমাজে তোমাদের শাসন করে আসছি। তোমরা সবাই কি আমার শাসন নিয়ে সন্তুষ্ট?’ কেউ কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবার সাথে গলা মিলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা সবাই সন্তুষ্ট।’

-তোমাদের আজ এখানে আমি একটি বিশেষ কথা বলার জন্য ডেকে এনেছি। তোমরা কি সেই কথাটি কেউ জান?

-না জানি না। সবাই একসাথে বলে উঠল।

-তোমরা জানো, আমি বহুদিন যাবৎ নিঃসঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন করছি। এখন আমার পথ চলার জন্য একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। এবার আমি একটা বিয়ে করতে চাই। ব্যাঙ প্রধানের এই বক্তব্যে সবাই আনন্দে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল।

মিয়াং আমার বলতে আরম্ভ করল, ‘তোমরা আজ থেকে আমার জন্য পাত্রী দেখা শুরু কর। যার দেখানো পাত্রী আমার পছন্দ হবে তার জন্য আমি বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা করব। এবার তোমরা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতে পার।’ মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে সমস্ত ব্যাঙ তাদের গর্তে ফিরে গেল। পরদিন কং খবর নিয়ে এলো পাশের ফড়িংপুর গাঁয়ে ফড়িংরাজার এক কন্যা আছে, ভারি সুন্দরী। মিয়াং কং এর কথা বিশ্বাস করল। সে ব্যাঙ সমাজের গণ্যমান্য ব্যাঙদের ডাকল মতামত নেওয়ার জন্য। অধিকাংশ বয়স্ক ব্যাঙ তার এ মতের বিরোধিতা করল। তারা বলল, ‘এটা এক প্রকার জুলুম। তোমার এটা করা কোনোমতেই উচিত হবে না। তোমার বন্ধু কং তোমার মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গলই কামনা করে।’ মিয়াং তাদের কথায় কর্ণপাত করল না মোটেই। বরং তাদের হুমকি দিল এই বলে যে, যদি তার এই মতের বিরোধিতা করা হয় তাহলে তাদের ডোবা থেকেই বের করে দেওয়া হবে। বৃদ্ধ ব্যাঙেরা মনঃক্ষুণœ হয়ে মিয়াংকে অভিশাপ দিতে দিতে বের হয়ে গেল। সময়মত ফড়িংরাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে এই হুমকিও দিয়ে পাঠানো হলো যে, যদি ফড়িংরাজা এই বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে সমস্ত ব্যাঙ একত্রিত হয়ে ফড়িং রাজ্যে আক্রমণ চালাবে। এ কথা শুনে ফড়িংরাজা ভয়ে কাঁপতে লাগল। বিশাল ব্যাঙবাহিনী যদি তার রাজ্য আক্রমণ করে বসে তাহলে পালানোর কোনো পথ থাকবে না।

ফড়িংরাজা তার কন্যাকে গিয়ে বললেন, ‘পাশের গাঁয়ের ব্যাঙরাজা তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি যদি বিয়েতে অমত করি তাহলে ওরা আমার রাজ্যে আক্রমণ চালাবে। এখন তুমি কী বল মা?’

ফড়িং কন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি একটি ব্যাঙকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। তুমি ব্যাঙরাজাকে না করে দাও।’

-তাহলে ওরা আমাদের সবাইকে মেরেকেটে শেষ করে তারপর উদরপূর্তি করবে।

-তাহলে চল আমরা এখান থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই।

-তা হয় না মা। আমাদের রাজ্যে অগণিত শিশু ফড়িং রয়েছে। তারা এখনো উড়তে পারে না। তাদের রেখে কী করে পালিয়ে যাই? তুই রাজি হয়ে যা মা। আমি ব্যাঙরাজাকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ফড়িংকন্যার আর কিছুই করার ছিল না। সে সারা দিন বসে বসে কাঁদত আর এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করত।

নির্দিষ্ট দিনে ব্যাঙরাজা তার দলবল নিয়ে বিয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। বরযাত্রী হিসেবে সবাইকে নিয়ে আসল শুধু যারা তার বিয়েতে অমত করেছিল তাদের ছাড়া। বৃদ্ধ ব্যাঙের দল বরং এতে খুশিই হলো। অন্যের ওপর জুলুম তারা সহ্য করতে পারে না। আকাশ সেদিন বেশ মেঘলা ছিল। যাবার সময় পথে থাকা অবস্থায়ই বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। ব্যাঙের দল খুশির চোটে নাচতে শুরু করে দিল। ব্যাঙরাজার খুশি যেন সবার চেয়ে একটু বেশিই! নাচের চোটে তার মাথার টোপর বেশ কয়েকবার কাদার ভেতর গড়াগড়ি খেল।

এদিকে ফড়িংকন্যার কান্নার কোনো বিরাম নেই। সে কিছুতেই ব্যাঙের সাথে এই বিয়েকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু সে ছিল অসহায়। সে শুধুমাত্র তার প্রার্থনার ওপরই বিশ্বাস রেখে যাচ্ছিল। নাচতে নাচতে ব্যাঙের দল ফড়িংরাজার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। এতগুলো ব্যাঙ একসাথে দেখে ফড়িংকন্যার গা ঘৃণায় রি-রি করে উঠল। সবগুলো ব্যাঙের শরীর ছিল কাদাপানিতে ভর্তি। ব্যাঙরাজা একটুও দেরি করতে চাইল না। সে তখনই হুকুম করল ফড়িংকন্যাকে নিয়ে আসতে। ফড়িংকন্যার মনোবল তখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। এই কদাকার ব্যাঙের হাত থেকে মুক্তি পাবার কি কোনো রাস্তাই খোলা নেই!

কাঁদতে কাঁদতে ফড়িংকন্যা বিশাল ব্যাঙের বহরের সাথে রওনা হয়ে গেল। তার নিজের ঠিকানা ছেড়ে অচেনা-অজানা পচা ডোবার রাজ্যে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। হয়ত এক দিনেই মারা যাবে। সেটাই বরং ভালো হবে। ব্যাঙের হাত থেকে তো চিরতরে মুক্তি পাওয়া যাবে! হঠাৎ আকাশ-বাতাস ঘন কালো হয়ে এলো। ব্যাঙের দল সব কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। ফড়িংকন্যা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না পানিতেই যাদের বসবাস তারা এমন মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে কেন! তার নিজের তো একটুও ভয় করছে না!

ব্যাঙের দল তাদের চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কেউ কেউ তখন লাফিয়ে চলতে আরম্ভ করেছে। আকাশে সহসা আলো ঝলকে উঠল। চড়াৎ চড়াৎ শব্দের সাথে মাটির দিকে আগুনের রেখা ছুটে আসতে লাগল। ব্যাঙের দল পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করে দিল। সুযোগ পেয়ে ফড়িংকন্যা একছুটে পালিয়ে বাড়ির পথ ধরল। বাজ এসে ব্যাঙগুলোর শরীরে পড়তে লাগল আর তারা এক এক করে মরতে শুরু করল। মিয়াং অতি কষ্টে ডোবার ধার পর্যন্ত যেতে পারল। হঠাৎ একটি বাজ এসে তার চলাও চিরতরে থামিয়ে দিল। পরদিন একটি বৃদ্ধ ব্যাঙ মিয়াংকে ডোবার সবচেয়ে উঁচু স্থানটিতে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করল যেখানে দাঁড়িয়ে সে সবার উদ্দেশ্যে তার ভাষণ দিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist