আব্দুস সালাম

  ২৬ আগস্ট, ২০১৭

কোরবানির মাংস

মিতারা চার ভাই-বোন। মিতা সবার বড়। সে হাইস্কুলে পড়ে। তার ইমিডিয়েট ছোট দুই ভাই তাসিন ও সাফিন পড়ে প্রাইমারি স্কুলে। আর সবার ছোট বোন এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। বাবা আব্দুল মতিন শহরে একটা অফিসে দপ্তরীর কাজ করে। শহরতলিতেই থাকে। মতিন সাহেবের সংসারে বেশ টানাটানি রয়েছে। তিনি সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হন। আসতে আসতে তার সন্ধ্যা হয়। সংসারের বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য তাকে প্রায়ই ওভারটাইম ডিউটি করতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা আর পোশাক-পরিচ্ছদের খরচ জোগাড় করতেও তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সংসারের টানাপড়েনের হিসাব-নিকাশ মিতাকে কিছুটা স্পর্শ করলেও অন্যান্য ছেলেমেয়েদের তা করে না। ঈদ এলে কিংবা বিবাহ ও জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলে মতিন সাহেবের পেরেশানিটা যে একটু বেড়ে যায় তা মিতা বুঝতে পারে। তাই সে বাবার নিকট এমন কিছু আবদার করে না যা রাখতে গেলে বাবার কষ্ট হয়। কিন্তু তার ছোট দুই ভাই ওসবের ধার ধারে না। প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবদের মতো তারা চলাফেরা করতে চায়। যখন তখন যা তা আবদার করে বসে।

প্রতিবছর ঈদে মিতার বাবাকে ধারদেনা করে বাড়তি খরচ জোগাড় করতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজার ঈদে তার বেশ কিছু ধারদেনা হয়েছে। সেই টাকা শোধ হতে না হতেই আবার কোরবানির ঈদ চলে এলো। ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক কেনার তেমন কোনো ঝামেলা না থাকলেও ঈদের জন্য বাজারহাট তো করতেই হবে। তাছাড়া দুই ছেলের ছোটখাটো অনেক আবদার রয়েছে। যার কিছুটা রক্ষা করতে হবে। তারা ইতোমধ্যে বায়না ধরেছে কোরবানির ঈদে নতুন জুতা কিনে দিতে হবে। কারণ রোজার ঈদে তাদেরকে জুতা কিনে দেওয়া হয়নি। নতুন জুতা না পেলে বন্ধুদের কাছে তাদের যেন মান থাকবে না। অবশ্য বড় মেয়ে মিতার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সে লক্ষ্মী মেয়ে। বাবার সামর্থ্যরে বিষয়টি সে উপলব্ধি করতে পারে। অবশেষে মতিন সাহেব দুই ছেলের জন্য নতুন জুতা কিনে আনেন। নতুন জুতা পেয়ে তারা খুশি হলেও অন্য কারণে তাদের মনটা খারাপ। বাবা কোরবানি দেবে না, তাই। অথচ তাদের বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবের বাবারা কোরবানি দেবেন। মিতা জানে বাবার জন্য কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব নয়। কিন্তু তার ছোট দুই ভাই অতসব বোঝে না। কোরবানির ঈদে কোরবানি দেওয়ার মধ্যেই যেন তারা আনন্দ খুঁজে পায়।

দু’দিন পরই ঈদুল আজহা। ঈদের আগের দিন মতিন সাহেব ফার্মের একটি মুরগি কিনে আনেন। ঈদের দিন সেটি জবাই করা হয়। মিতা ও মিতার মা দুইজন মিলে সকালবেলায় রান্নাবান্না করার কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা মুরগির মাংস ও সেমাই সুজি রান্না করেছে। দুই ছেলে খাওয়া-দাওয়া করে বাইরে ঘুরতে বের হয়। সকালবেলাটা ঘোরাঘুরি করে দুপুরে ফিরে আসে। এবার তারা গরু বা ছাগলের মাংস দিয়ে ভাত খেতে চায়। মা বলে, রাতে রান্না করে দেব। এখন তোরা মুরগির মাংস দিয়েই ভাত খেয়ে নে। মায়ের বিশ্বাস- প্রতিবেশীর অনেকেই কোরবানি দিয়েছে। তারা নিশ্চয় প্রতিবারের মতো এবারও মাংস দিয়ে যাবে। সেগুলো রান্না করে দিলেই ছেলেমেয়েদের আবদার রক্ষা হবে।

যারা কোববানি দিয়েছে তাদের বাড়িতে দুপুর থেকেই ফকির-মিসকিনদের আনাগোনা শুরু হয়। বেশিরভাগ ফকির হতাশ। দীর্ঘক্ষণ বাড়ির গেটের সামনে অপেক্ষা করেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। আর যারা সৌভাগ্যবান তারা হয়তো দুই এক টুকরা মাংস পাচ্ছে। ঠোঁটে হাসির রেখা দেখলেই বোঝা যায় তারা মাংস পেয়ে সন্তুষ্ট। তারপর দ্রুত কদমে আবার অন্য বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে চলে। এদিকে মিতা ও তার মা দুপুর থেকেই অপেক্ষা করতে থাকে প্রতিবেশীদের মাংসের জন্য। মাত্র দুই একজন মাংস দিয়ে গেছে, যা পরিমাণে খুবই কম। বেলা যত বাড়তে থাকে মায়ের তত টেনশন বাড়তে থাকে। দুই ছেলেকে গরু বা ছাগলের মাংস দিয়ে ভাত খেতে না দিলে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। দিন শেষে দেখা গেল তারা যা মাংস পেয়েছে তা হয়তো কেজি খানেক হবে পারে। এতেই মা খুশি। অন্তত ছেলেদের কাছে তো তাদের মান রক্ষা হবে। নিজে নাই বা খেল।

রাতের বেলায় মা মাংসগুলো রান্না করল। ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে মা-বাবা মাংস খায়নি বলেলই চলে। তবুও এক বেলাতেই সব মাংস শেষ হয়ে গেল। দুই এক টুকরা মাত্র হাঁড়ির নিচে পড়ে থাকল। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর ছেলেরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন খুব সকালেই তারা ঘুম থেকে উঠে পড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের কাছে খাবার চায়। মা তাদের মাংসের পরিবর্তে অন্য তরি-তরকারি দিয়ে খেতে দেয়। তারা মাংস দিয়ে খাবার খেতে চায়। কিন্তু মা দিতে পারে না। তাই তারা মায়ের সাথে রাগারাগী করে। মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য জেদ করে। তারা মায়ের মুখে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, কেন আব্বা ঈদের দিনও মাংস কেনেনি? মা চুপ করে কথাগুলো শুনতে থাকে। আর মাঝে মাঝে মা তাদেরকে সান্ত¡না দিয়ে বলে, তোদের পরে রান্না করে দেব। এখন যা আছে তা দিয়েই খেয়ে নে। মিতা পাশের রুমে চুপ করে বসে বসে সব কথা শোনে। তার দু’চোখ জলে ভরে যায়। সে বুঝতে পারে প্রতিবেশীদের মাংসের আশায় বাবা মাংস কেনেনি। কিন্তু মা-বাবা বুঝতে পারেনি যে, যারা কোরবানি দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের ঘরেই এখন ফ্রিজ রয়েছে। কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা তারা ভুলতে বসেছে। ফলে নামমাত্র মাংস বিলি করে সব মাংস ফ্রিজে রেখে দিয়েছে তারা। যাতে সারাবছর কোরবানির মাংস খাওয়া যায়। তাই প্রতিবেশীর হক হিসেবে এবার মিতাদের ভাগে তেমন মাংস পড়েনি।

মিতা দুই ভাইকে বুঝিয়ে বলে, তোমরা মাংস খাওয়ার জন্য মা-বাবার সঙ্গে রাগারাগী করলে মা-বাবা কষ্ট পাবে। মা-বাবা কষ্ট পেলে আল্লাহ কষ্ট পাবে। তাই আমাদের উচিত মা-বাবাকে কষ্ট না দেওয়া। আমরা সবসময় চেষ্টা করব তাদের খুশি রাখতে। বাবার হাতে টাকা থাকলে দেখবে ঠিকই মাংস কিনে আনবে। এখন একটু ধৈর্য ধর। বোনের কথা শুনে দুই ভাই শান্ত হয়। অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। তারপর মাংস খাওয়া নিয়ে তারা আর মায়ের সঙ্গে রাগারাগী করেনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist