সারমিন ইসলাম রত্না
নীল পরীদের ডানা
লাবণীর পরী হবার খুব সখ। প্রায়ই সে বাবা-মাকে বলে, ‘আব্বু আম্মু আমাকে একটা পরীর ড্রেস বানিয়ে দেবে, দুটো ডানা বানিয়ে দেবে।’
‘দেব মামণি দেব।’ বাবা-মা বলল। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন।
আজ একুশে নভেম্বর। লাবণীর জন্মদিন। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গিয়েছে লাবণী। তার চুলগুলো আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে। কাঁধ থেকে নেমেছে পিঠ অবধি। চোখ দুটো হয়েছে পদ্ম ফুলের মতো। সে নিজেও লম্বা হয়েছে বেশ। আয়নায় নিজেকে দেখে লাবণী ভাবে আমি তো একটা তুষার কন্যা। এখন কেক কাটা হবে। রং বেরঙের বেলুন সাজানো হয়েছে ঘরটিতে। একটি না দুটি না সাতটি মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। কারণ আজ সাত বছর পূর্ণ হলো লাবণীর। জন্মদিনের কেকটা সামনে রেখে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে ছোট্ট মেয়ে লাবণী। বাবা দাঁড়িয়েছেন লাবণীর ডান পাশে আর মা দাঁড়িয়েছেন লাবণীর বাম পাশে। একে একে লাবণীর বন্ধুরা লাবণীর দিকে উপহারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। তারপর গান ধরল সুরে সুরে, Happy Birthday To You... Happy Birthday To You... Happy Birthday Dear Friend Labony... Happy Birthday To You...ধপ করে নিভে গেল ঘরের সমস্ত আলো। শুধু মোমবাতিগুলো জ্বলছে। বাবা-মা দুজনে একইসঙ্গে বলে উঠলেন। ছোট বন্ধুরা ভয়ের কিছু নেই। এখন তোমরা চোখ বন্ধ কর লাবণী নিজেও চোখ বন্ধ করবে, আর হ্যাঁ এলার্ম না বাজা পর্যন্ত চোখ খুলবে না কিন্তু। বাবা গুনতে শুরু করলেন এক দুই তিন চার মাত্র দশ সেকেন্ড পর টিকটিক শব্দে বেজে উঠল এলার্ম। ঘরের সব আলো একসঙ্গে জ্বলে উঠল। চোখ খুলল সবাই সঙ্গে সঙ্গে। কী দারুণ, লাবণী কোথায়! এতো একটি পরী দাঁড়িয়ে আছে। ঝলমলে নীল রঙের পরী। লাবণী মিষ্টি একটা হাসি দিল। হ্যাঁ বন্ধুরা আমি পরী হয়ে গেছি। কেমন লাগছে দেখতে আমাকে? খুব সুন্দর খুব সুন্দর। হাততালি দিতে দিতে বলতে লাগল লাবণীর বন্ধুরা। খুশিতে কেঁদে ফেলল লাবণী। কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি বিস্মিত, সত্যিই আমি বিস্মিত। মেয়ের খুশি দেখে বাবা-মাও খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। সিঁড়িতে হালকা ভলিউমে গান বেজে উঠল, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথী মোদের ফুলপরী, ফুলপরী লালপরী, নীলপরী লালপরী সবার সাথে ভাব করি, সবার সাথে ভাব করি।’ গানের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল লাবণী। নাচতে শুরু করল তার সব বন্ধুরাও।
এখন অনেক রাত, অতিথিরা যে যার বাড়িতে চলে গেছে। লাবণী একদৌড়ে ছুটে এলো তার ঘরে। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল লাবণী। সত্যি সে পরী হয়ে গেছে। এইটা কি আমি? আয়নার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো ছোট্ট একটি পরী, নীল রঙের পরী। পরীটা লাবণীকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে বলল, হ্যাঁ লাবণী এটা তুমি। তুমি একটা নীলপরী, তাকিয়ে দেখ আমিও একটা নীলপরী। লাবণী দু চোখ ভরে সে পরীটাকে দেখতে লাগল, পরীরা কত্ত সুন্দর হয়। নীলপরী লাবণীর হাতে হাত রেখে বলল, আজ থেকে আমরা বন্ধু। চল তোমাকে আমাদের দেশে বেড়াতে নিয়ে যাই।
পরীর দেশে পা রাখতেই চমকে উঠল লাবণী। কী নরম তুলতুলে মাটি। পা যেন ডুবে যাচ্ছে একেবারে, আরে এ তো মাটি না, রাশি রাশি ফুলের পাপড়ি। লাবণীর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল একঝাঁক পরী। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা, খয়েরি, গোলাপি কত রকমের পরী। পরীরা নেচে নেচে স্বাগত জানাল ছোট্ট পরী লাবণীকে। লাবণী বলল, ‘আমি তোমাদের সব্বার বন্ধু হতে চাই।’ ‘তুমি আমাদের সবার বন্ধু। চল্ তোমাকে ঝরনা দেখাতে নিয়ে যাই।’ ফুলের সুবাস ছড়ানো একটি বাগানে উপস্থিত হলো লাবণী। দেখল হাজারো রঙের হাজারো রকম ফুল ফুটে আছে। সেই ফুলের ওপর বসে আছে চোখ জুড়ানো মন ভুলানো লাখ লাখ প্রজাপতি। আরো দেখল সবুজ পাহাড়ের ওপর থেকে ঝরে পরছে আয়নার মতো স্বচ্ছ জলের ঝরনা। লাবণী বলল, ‘এত সুন্দর তোমাদের দেশ।’ একটা লালপরী বলে উঠল, ‘তার চাইতেও তুমি অনেক সুন্দর।’ ‘তাই বুঝি?’ লাবণী মিষ্টি একটা হাসি দিল। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ লাবণীর চোখে পড়ল তার সামনে দাঁডিয়ে রয়েছে সোনা রুপায় গড়া অপূর্ব সুন্দর একটি প্রাসাদ। লাবণী পরীদের বলল, ‘আমাকে ওই প্রাসাদে নিয়ে যাবে?’
‘নিশ্চই নিয়ে যাব। চল।’ এক ঝাঁক পরীর সঙ্গে লাবণী সেই প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে পড়ল, প্রাসাদের রক্ষী তাদের দেখে বলল, ‘তোমরা এই ছোট মেয়েটিকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছ?’ ‘পৃথিবী থেকে নিয়ে এসেছি। ঠিক আছে ওকে তোমরা রানীর কাছে নিয়ে যাও।’ হীরা-মণি-মুক্তাখচিত একটি সিংহাসনে বসে আছেন পরীরানী, রংধনুর সব রং যেন তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সুন্দরী পরীরানীকে দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ছোট্ট মেয়ে লাবণী। হাজার হাজার পরী তার চোখে মুখে গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল লাবণী। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। পরীরানী মিষ্টি সুরে গান ধরলেন, ঘুমের দেশের মেয়ে তুমি, ঘুমের দেশের মেয়ে, আলসে বড় কেমন তর ঘুম কাতুরে। লাবণী টুপ করে চোখ মেলে তাকাল। পরীরানী হাত ইশারায় ছোট্ট মেয়ে লাবণীকে তার কাছে ডাকলেন। লাবণী এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল। পরীরানী লাবণীকে আদর করে তার পাশে বসালেন, বললেন, ‘তুমি আয়নায় নিজেকে কখনো দেখেছ?’ লাবণী বলল, ‘দেখেছি।’
‘কী মনে হয়?’
‘সুন্দর তবে তোমার মতো নয়।’ পরী রানী ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললেন তুমি আমার চেয়েও অনেক সুন্দর। এই নাও, তোমাকে কিছু নীল পরীদের ডানা দিলাম, এগুলো তোমার নিজের কাছে রেখে দেবে। তুমি পরীরাজ্যে বেড়াতে এসেছ তাই আমাদের সবার পক্ষ থেকে এগুলো তোমার উপহার। লাবণী হাত বাড়িয়ে পরীরানীর উপহার মহা আনন্দে গ্রহণ করল। অবাক চোখে দেখতে লাগল তারা ঝলমলে নীল রঙের ডানাগুলো। তারপর ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিয়ে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ পরীরানী অনেক ধন্যবাদ।
মামণি, এই মামণি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল লাবণী। স্যরি, পরীরানী স্যরি, আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
চোখ কপালে তুললেন আম্মু, বললেন- পরীরানী! আমি তোমার আম্মু।
‘দুষ্ট মেয়ে রাতের বেলা পরীর জামাটা পরেই ঘুমিয়েছে, পিঠের উপর থেকে ডানা দুটোও খুলে রাখেনি। এখন ঘুমের ঘোরে কি সব আবোল তাবোল বকছে। উঠে পড় তো।’ লাবণী হাই তুলে বলল, ‘উঠছি আম্মু।’
‘ঠিক আছে তুমি রেডি হও, এদিকে আমি তোমার নাস্তা তৈরি করছি, ৭টা কিন্তু বেজে গেছে স্কুলে যেতে হবে।’ লাবণী আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘আচ্ছা আম্মু।’
জানালা খুলে দিয়েছেন আম্মু। সকালের মিষ্টি রোদে লাবণী তার বালিশের পাশে স্পষ্ট দেখতে পেল পরীরানীর উপহার দেওয়া ঝিকিমিকি তারার মতো সেই নীল পরীদের ডানাগুলো। তাহলে ঘুমের মধ্যে সত্যি সত্যি কি লাবণী পরীর দেশে চলে গিয়েছিল। মনে মনে পরীরানীকে আবারও ধন্যবাদ দিল ছোট্ট মেয়ে লাবণী।
"