আব্দুস সালাম
সুনিকার কান্না
মনিকা ও সুনিকা দুই বোন। মনিকা বড় আর সুনিকা ছোট। বাবা সরকারি চাকরি করে। সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে তাদের বাসা। বাসাটি নিচতলায়। কোয়ার্টারের সামনে একটু খালি জায়গা রয়েছে। সেখানে সকাল-বিকাল কোয়ার্টারের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। মনিকাদের পাশের ফ্লাটে মীমদের বাসা। এক মাস হলো তারা এখানে এসেছে। মীমের বয়স মনিকা ও সুনিকার বয়সের মাঝামাঝি। তাই দুই বোনের সঙ্গেই মীমের ভালো সম্পর্ক। মীম দুই বোনেরই বান্ধবী। তারা সুযোগ পেলেই একসঙ্গে খেলাধুলা করে। পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারণে কিছুদিনের মধ্যে তাদের পারস্পারিক সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়।
মীমের মা কড়া মেজাজের। যেকোনো বিষয়ে চট করে রেগে যায়। আগে-পিছে চিন্তাভাবনা না করে যার তার সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। একদিন মীম, মনিকা ও সুনিকা একসাথে খেলা করছিল। খেলা করতে করতে মীম মাটিতে পড়ে যায়। পায়ে সামান্যও ব্যথা পায়। অমনি মীমের মা অভিযোগ করে যে, মনিকা না হয় সুনিকা মীমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। যদিও দুই বোনের কেউই মীমকে ধাক্কা দেয়নি। এই নিয়ে দুই মায়ের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। অন্য এক দিন সুনিকা মীমের সাথে খেলা করার সময় মীমকে পচা বলে। তা নিয়েও মীমের মা সুনিকার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। মীমে মা মনিকা ও সুনিকাকে চোখ রাঙিয়ে বলে : আর কক্ষনো যেন এ রকম কথা না শুনি। সে আরো বলে, ‘যদি কখনও শুনি তোমরা আমার মেয়েকে আজেবাজে কথা বলেছ, তাহলে তোমাদের সঙ্গে আমার মেয়েকে আর খেলতে দেব না।’
মীমের বাবা ভালো মানুষ। প্রতিবেশীর সঙ্গে স্ত্রীর এরূপ ব্যবহারে সে স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট। তার এ ধরনের কড়া নিষেধ সে মোটেও মানতে রাজি নন। তার কথা হলো- বাচ্চারা একসাথে খেলাধুলা করলে এ রকম হতেই পারে। তাই বলে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা বন্ধ করে দিতে হবে? মীম যদি কখনও রাগ করে মনিকাদের সঙ্গে না মেশে তখন সে নিজ উদ্যোগে মনিকা ও সুনিকার সঙ্গে মীমের মিল করিয়ে দেয় এবং তাদেরকে একসাথে খেলাধুলা করতে বলে। তখন তারা আবার কথাবার্তা বলে। একসঙ্গে খেলাধুলা করে। তারপরও তাদের মায়েরা কেউ কারোর সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। কারণ ইতোমধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে তারা বেশ কয়েকবার ঝগড়াঝাটি করেছে। যদিও দুই বাবা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের মধ্যে কখনও রাগারাগি কিংবা কথা কাটাকাটিও হয়নি। তারা বাচ্চাদের কখনও ভুল ধরত না। তারা জানে ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সমবয়সী সঙ্গীসাথীর খুব প্রয়োজন। বড় বড় শহরে যার খুব অভাব রয়েছে। স্ত্রীদের কোনো অভিযোগ পেলে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলে।
মায়েদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ থাকার কারণে বাচ্চাদের ওপর তার বেশ প্রভাব পড়ে। মনের আনন্দে তারা খেলাধুলা করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে মীমের মা মীমকে নিষেধ করে দিল যে, সে যেন কোনভাবেই মনিকা ও সুনিকার সাথে না মেশে। এমনকি তাদের সাথে যেন কথাও না বলে। মায়ের আদেশ মীম ঠিক ঠিকভাবে পালন করছে। সে আর মনিকাদের সাথে কথা বলে না, মেশে না। মীম যখন ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করে তখন মনিকা ও সুনিকা তাদের সাথে খেলে না। আবার মনিকা ও সুনিকা যাদের সাথে খেলা করে মীম তাদের সাথে খেলে না। শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ফ্ল্যাটের বাচ্চারা বাইরে না খেললেও দুই বোন একসঙ্গে খেলা করে। তখন মীমের খুব ইচ্ছা হয় মনিকাদের সাথে খেলা করতে। খেলা করার জন্য তার জানটা ছটফট করে। কিন্তু মায়ের কড়া শাসনের কাছে তার ইচ্ছা হার মানে।
সুনিকা সবার ছোট। সে মান-অভিমানের কিছুই বোঝে না। সে সবার সাথে খেলতে চায়। তবে মীমের মাকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। পাশাপাশি থাকার কারণে বাচ্চাদের মধ্যে আবার মিলও হয়ে যায়। আবার তারা একসঙ্গে খেলা করে এবং কথাবার্তা বলে। তবে তাদের মায়েদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয় না। যাহোক, এভাবে প্রায় বছর পার হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে মনিকা ও মীমদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কের খুব অবনতি হয়। কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। মেয়েরাও এখন আর কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। যদিও দুই ঘরের দুই দুয়ার মুখোমুখি। দুয়ার খোলা থাকলে একজন অপরজনকে দেখতে পায়। অথচ কেউ কারোর সাথে মেশে না, কথাবার্তা বলে না। এভাবেই তারা দিনাতিপাত করছে।
মীমের বাবা কিছুদিন আগে অন্য একটি সরকারি কলোনিতে ভালো বাসা বরাদ্দ পেয়েছে। ক’দিন পরেই তারা সেখানে চলে যাবে। নতুন বাসাতে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। মীমের মনটা খারাপ। সে এই এলাকা ছেড়ে যেতে চায় না। এদিকে সুনিকা একদিন তার মাকে বলে : ‘মা, মীম আমার সাথে কথা বলে না কেন? আমার সঙ্গে খেলে না কেন?’
: ওর সাথে তোমার খেলতে হবে না। কদিন পরেই ওরা এখান থেকে চলে যাবে। এখন ওর সাথে মেলামেশা না করাই ভালো।
এই ভালোর মর্মার্থ সুনিকা কিছুই বুঝল না। সে শুধু বলল, ‘কোথায় যাবে?’
: অনেক দূরে। ওরা আর কখনও এখানে আসবে না। নতুন যারা আসবে তুমি তাদের সাথে খেলবে।
: তারা কি আমার সাথে কথা বলবে? খেলা করবে?
: অবশ্যই। তারা তোমার সঙ্গে কথা বলবে, খেলা করবে, এমনকি তোমাকে আদরও করবে।
: ওই বাবুটার মা যদি আমাকে বকা দেয়, আমার সঙ্গে খেলতে না দেয়?
সুনিকার মা অবশ্য এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। শুধু নীরব থেকেছে।
মীমরা বাসা ছেড়ে দেওয়া জন্য জিনিসপত্র গুছিয়েছে। ট্রাকে মালসামানা ওঠানো হয়েছে। মীম বারবার ঘরের বাইরে আসা-যাওয়া করছে। সে সুন্দর একটি জামা পরেছে। জানালায় দাঁড়িয়ে মনিকা ও সুনিকা মীমকে দেখছে। কিন্তু কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। কিছুক্ষণ পর মালসামানা নিয়ে ট্রাকটা চলে গেল। মীম ও তার বাবা-মা একটি মাইক্রোবাসে উঠল। মীমের মনটা খুব খারাপ। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। মনিকা সুনিকাকে বলল, ‘মীমরা চলে যাচ্ছে। আর আসবে না। ওদের সাথে আমাদের আর দেখা হবে না।’ এই কথা শুনে সুনিকা ঘরের ভিতর চলে গেল এবং খাটের উপরে একটা বালিশের নিচে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করল। ঘরের ভেতর সুনিকার কান্নার শব্দ শুনে মনিকা ও তার মা সুনিকার কাছে ছুটে গেল। মা সুনিকাকে বলল : ‘কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?’
: না কিছু হয়নি। আমার মনটা খারাপ।
: কেন?
: মীমরা চলে গেল তো, তাই।
"