মারিয়া রহমান প্রাচী
উপলব্ধি
আজকাল আমি সেই মেঘেঢাকা আকাশের নিচ দিয়ে হাঁটি না। যাই না সেই বকুল গাছটির কাছেও! বকুল গাছটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগত! মনে হতো সে আমারই অংশ। আমার মতে, মানুষ সেই সকল জিনিসকেই বেশি পছন্দ করে যা একান্তই তার আপন। তাই তো সেসব বিষয়ে নিজেকে খোঁজে, নিজের অস্তিত্বের আভাস মিললে সে আবেগে আপ্লুত হয় আনন্দে! সেই আনন্দটা এক বেগভর্তি টাকা পাওয়ার মতো নয়! সেই আনন্দ হলো বৃষ্টির পর হালকা নীল আকাশের মাঝে সাতটি রং খুঁজে পাওয়ার মতো। এক দিন ব্যালকনিতে বসে গুনগুন করে গান গাচ্ছিলাম! ছোটবেলা থেকেই গানের কোনো লাইন আমার তেমন মনে থাকে না! কয়েকটা শব্দ এলোমেলো করে নিয়েই গুনগুন করা আমার অভ্যাস। হয়তো বিশেষ কোনো কারণ নেই, কিন্তু যে গান আমাদের পছন্দের হয় আমরা তা মুখস্থ করতে পারি না। কারণ পছন্দের গানটায় যদি মনোযোগ দেই অথবা তার অর্থ বোঝার বা মনে রাখার উদ্দেশ্যে শোনা হয়, তখন আর সেই গান শোনার মজাটা থাকে না। যেমন-যে বই বা গল্প আমরা কিছু শিখার জন্য পড়ি তা থেকে শুধু শিখতেই পারি, কিন্তু গল্পের আসল মজাটা পাই না। আর অন্যদিকে মজা পেতে চাইলে এক গতিতে পড়তে থাকি, ফলে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় তেমন আলাদাভাবে নজরে পড়ে না!
আসলে এক সাথে দুটা বিষয়ে মানুষ চিন্তা করলেই বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়!
এসব আজগুবি কথা আমার মাথায় আসে বলে নিজের উপর কিছুক্ষণ হাসতে হাসতে আবার চুপ হয়ে গেলাম। আমি তখনও আমি ব্যালকনিতে দাঁড়ানো। নিচের দিকে লক্ষ করতেই চোখে পড়ল-একজন ভদ্রলোক বৃদ্ধ ভিক্ষুককে হঠাৎ ঠাস করে চড় মারল! আমি একটু চমকে গেলাম! যদিও খুব একটা বিস্ময়কর কিছু ছিলো না এতে। ঢাকা শহরে এটা খুব স্বাভাবিক। চমকে ওঠার কারণ ছিল ভিক্ষুকটা অনেক বৃদ্ধ, পাশাপাশি সে এমন কিছুই করেনি যার ফলে তাকে চড় খেতে হবে! আসলেই কি লোকটি ভদ্র? কিছু বড়লোক শ্রেণির মানুষ নিজেদের কিছু অবৈধ অর্থের গরম দেখায় আর নিজেকে ভদ্রলোক বলে দাবি করে! এবং আমাদের সমাজে সে তার ভদ্রলোক হওয়ার ব্যানার তথা দামি পোশাক লাগিয়ে চলাফেরা করে। এমন ভদ্র লোকের অভাব নেই ঢাকা শহরে। গায়ে কোর্ট, টাই আর চোখে কালো চশমা লাগিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় পৃথিবী মনে করে! আসলে ওরা যে কতটা তুচ্ছ তারা নিজেরাও তা উপলব্ধি করতে পারে না। শুনেছিলাম, এক লোক নিজের বিশালতা সিদ্ধ করার জন্য পুকুরে ঝাঁপ দেয়, সে সম্পূর্ণ পুকুর সাঁতরে পার করে নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে! তারপর দেখে সামনে একটা ঝিল। সেটাও সে কষ্টে পার করে। তারপর দেখে সামনে পদ্মা নদী। সে ভাবে এ ঝিল পদ্মা নদীর বিশালতার সামনে কিছুই না। অবশেষে সে কষ্ট করে পদ্মা নদী পার হতেই দেখে সমুদ্র যার একটা স্রোতে কয়েকটা পদ্মা নদী বিলীন হয়ে যাবে। তারপর সে উপলব্ধি করে সে কতটা তুচ্ছ! কিন্তু ‘রিচ সোসাইটি’ নামে এক গোষ্ঠী রয়েছে-যারা ভদ্রলোক নামে আর পোশাকে! তবুও এসব উপলব্ধি করতে পারে না। কেউ যদি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়, তাহলে সেই তথাকথিত ছোটলোকের সর্বস্বান্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেয়! ভদ্রলোকরা নরম ভাবে কথা বলতে জানে না, তাদের কণ্ঠে এক রকম গরম ভাব চলে আসে! তাই ক্ষুদ্র ভিক্ষুককে মেরে সে নিজেকে বড় মনে করল! আসলে সে প্রমাণ করল, সে কতটা তুচ্ছ! যে নিজের ভালো-মন্দ আজও উপলব্ধি করতে পারল না। গরম মেজাজে কেমন করে দাবি করে সে ভদ্রলোক! তা আমি আজও উপলব্ধি করতে গিয়ে ব্যর্থ!
"