শামীম শিকদার

  ২৫ জুলাই, ২০২০

রোহানের বৃষ্টিভেজা গল্প

দুষ্টুমি করে মায়ের বকুনি খেয়ে বাড়ি থেকে একটু দূরে আনমনে বসে আছে রোহান। বসে বসে মনের ইচ্ছার বাইরে খুব অযতœ করে নানা কথা ভাবছে সে। তার ভাবনাগুলোর গভীরতা তার কাছে হয়তো অনেক মূল্যবান। ভাবনা থেকে মাঝেমধ্যে তার মনের ভেতরে কয়েকটি প্রশ্নও জমা হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই খুঁজে বের করতে পারলেও বাকিগুলো জানার বহু আগ্রহ নিয়ে উত্তর খুঁজে যাচ্ছে।

মাথার ওপরের বিশাল সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তি খোঁজার সময় রোহানের চোখে পড়ল মেঘে ঢাকা পড়ে সব আঁধারে পরিণত হওয়ার দৃশ্য। সূর্যি মামাও কোথায় যেন লুকোচুরি খেলছে। আকাশের ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে দল বাঁধা ও ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। সে মেঘগুলোর কত রং। সাদা মেঘ, সবুজ মেঘ, ধূসর মেঘ। হিঙ্গুল মেঘ, সিঁদুরে মেঘ, পটকিলে মেঘ। আরো কত বিচিত্র নাম ঊর্না মেঘ, হাঁড়িয়া মেঘ, হিঙ্গলে মেঘ, কু-ল মেঘ, অলম মেঘ, কোদালে মেঘ, এমনি কত মেঘ। কত রূপ কত কত রং, কত নাম নিয়ে মেঘ খেলা করে বিশাল আকাশের বুকে। ভাবতে ভাবতে মেঘ গলে বৃষ্টি হয়ে অঝরে আকাশ থেকে ঝরতে লাগল। হঠাৎ বৃষ্টি নামাতে কোনো কিছু ভেবে উঠতে না পারায় মায়ের সঙ্গে করা অভিমানের কথা ভুলে রোহান দৌড়ে চলে এলো তাদের বাড়িতে। বৃষ্টির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পেরে উঠতে না পারায় শরীরের অনেকটা অংশ ভিজে গেছে। রোহানের শরীরে আধা ভেজা কাপড় দেখে শরীর মোছার জন্য তার মা গামছা নিয়ে তার কাছে আসতেই মায়ের সঙ্গে খুব অভিমান করে বলছে, তুমি না আমাকে বকেছো, তবে এখন আমার কাছে আসছো কেন? তুমি শুধু আমাকে বক; একটুও আদর করো না। রোহানের কথা শুনে তার মায়ের অশ্রুভেজা নয়নে এক টুকরো মায়া ভরা ছবি ফোটে উঠেছে। খুব আবেগমাখা কণ্ঠে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলছে আর কখনো বকব না বাবা, এখন তুমি কাছে আসো। তুমি দুষ্টুমি করো বলেই তো আমি বকি। তোমার ভেজা শরীর নিয়ে থাকলে ঠা-া-জ্বর হবে, তোমার জ্বর হলে তো তোমার আম্মুর কষ্ট হবে। মায়ের কথা শুনে রোহানের মনের ভেতরে গড়ে ওঠা অভিমানের পাহাড় ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল। বাধ্য ছেলের মতো মায়ের কাছে চলে গেল সে। আর কখনো দুষ্টুমি করে বকা খাবে না বলেও সে তার মায়ের কাছে কথা দিয়েছে।

মায়ের কাছে দেওয়া কথা ভুলে পরের দিনই ফুলের খুঁজে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। বর্ষাকালে ফোটে এমন অনেক ফুলের নাম সে তার দাদুর মুখে শুনেছে। তার মধ্যে কেয়া, কদম, কলাবতী, শাপলা, পদ্ম, ঘাসফুল, পানা ফুল, কলমি ফুল, কচুফুল, ঝিঙে ফুল, কুমড়া ফুল, হেলেঞ্চা ফুল, কেশরদাম, পানি মরিচ, পাতা শ্যাওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাটা, কেন্দারসহ বহু নামের নানা রঙের ফুল। এমনও অনেক ফুল আছে যা সে কখনো দেখেনি শুধু নামেই তাদের চিনে। তবে রোহানের স্কুলের পাশে একটি বিশাল বড় কদম ফুলের গাছ রয়েছে। কচি সবুজ পাতার ফাঁকে যখন কদম ফুল দেখা যায়, তখন তাদের স্কুলের সব ছাত্র উল্লাসের সঙ্গে ফুল ছেঁড়ার আগ্রহ নিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে। কারণ তারা যখন গাছে ওঠার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, ঠিক তখনই স্কুলের ভেতর থেকে তাদের শিক্ষক বের হয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে একটি ধমক মারে। স্যারের চেঁচিয়ে ওঠা শব্দ শুনে অনেকটা ভয়ের সঙ্গে ফুল ছেঁড়ার আগ্রহ বাদ দিয়ে সবাই শ্রেণিকক্ষের ভেতরে গিয়ে চুপ করে বসে। যারা স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিয়ে ফুল ছিঁড়তে পারে, তারা তা অন্যদের চোখে লোভের সৃষ্টি করে। কদম ফুলের ঘ্রাণ রোহানের বেশ ভালো লাগে। ফুল ছিঁড়তে না পারলেও তাদের শ্রেণিকক্ষ থেকেই সুন্দর মনোমুগ্ধকরভাবে ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া যায়। স্কুলের কাছের কদমগাছটিতে কড়া নজরদারির কারণে কেউ কাছেই আসতে পারে না। কিন্তু স্কুল থেকে ক্ষাণিকটা দূরে শাওনদের বাড়ির কাছেই একটি বিশাল বড় কদম ফুলগাছ রয়েছে। গাছটিতে যেমন ঘন সবুজ কচি পাতা, তেমনই ছোট-বড় কদম ফুল। ওইখানে ফুল ছিঁড়লে তাদের তেমন কেউ বাধা দেয় না। রোহান ও শাওন ফুল ছিঁড়ে ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে আসে। রোহানের মা যখন তার হাতে ছেঁড়া ফুল দেখে, তখন ছেলেকে শাসনের সুরে বলতে থাকে, তুই আবার ফুল ছিঁড়েছিস? ফুলগাছেই সুন্দর মানায়, মানুষের হাতে নয়। রোহান জানে, তার হাতে ফুল দেখলে তার মায়ের বকুনির শেষ থাকে না, তাই সে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেঁড়া ফুল দিয়ে খেলা করে।

বাড়ি থেকে রোহানের স্কুলের দূরত্ব ১০ মিনিটের। কিন্তু তার স্কুলে যেতে যেতে সময় লেগে যায় ৩০ মিনিট। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নানা জিনিস নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কারণে তার সময় যেকোনো দিক দিয়ে চলে যায়, তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়ে ‘নির্ঝর বিল’ নামে একটি বিল। সে বিলে পানির ওপর কচুফুলের সঙ্গে লাল-সাদা শাপলা বাতাসের ধাক্কায় খেলা করে। শাপলা তোলার জন্য একপাশ দিয়ে ছোট একটি ডিঙ্গি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তাদের গ্রামের কয়েকজন মানুষ। ডিঙ্গি ভরে শাপলা তুলে তা পরিষ্কার করে বাজারে বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তারা জীবিকা নির্বাহ করলেও সে দৃশ্য দেখতে রোহানের খুব ভালো লাগে। তাই স্কুলে যাওয়ার পথে কেউ যদি বিল থেকে শাপলা তুলে, তখন সে চুপ করে তার স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে নীরব মনে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে।

রোহানের ব্যাগে সব সময় একটি ছাতা বা রেইনকোট থাকে। কারণ সে কোনোভাবেই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কখন বৃষ্টি নামবে আর বৃষ্টি থামবে। প্রখোর রোদের মধ্যেও হঠাৎ করে মেঘ এসে কান্না শুরু করে দিয়ে মাঠঘাট সব ভিজিয়ে দেয়। আর মুহূর্তেই সে কান্না থেকে আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে হাসতে থাকে। বৃষ্টির কত রূপ আর বর্ষার কত সাজ। হঠাৎ হঠাৎ মেঘের পাহাড় গলে বৃষ্টি হয়ে অঝরে আকাশ থাকে ঝরতে থাকে; তাতে কোনো বিরাম নেই। আকাশ গর্জে উঠে বিদ্যুৎ চমকায়। বাতাস পাগল হয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ তোলে ছোটে। এ গ্রামে আছে তো ও গ্রামে নেই। হৃদয় আকুল করা বৃষ্টির মধ্যে কখনো কখনো গর্জে উঠে মনে ভয় লাগিয়ে দেয়। মেঘে ঢাকা আকাশ দেখলে মনে হয় একটু হাঁটলেই বুঝি হাতে ছোঁয়া যাবে। কিন্তু আকাশের সীমানা খুঁজে পেতে হলে একটু হাঁটতে হবে, একটু হাঁটতে হবে সান্ত¦না মনকে নাড়া দেয়। বৃষ্টির কত রূপ, কত সাজ। সবচেয়ে বেশি মজা রোদমাখা খেঁকশিয়ালের বিয়ের বৃষ্টি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close