ইসরাত শিউলী

  ১১ জুলাই, ২০২০

টুনির লজেন্স-দৌড়

সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে টুনি, পুরো নাম টুনটুনি। পড়াশোনায় কিঞ্চিৎ কাঁচা এবং ভীষণ রকম ফাঁকিবাজ। মায়ের ভাষায়Ñ ‘অক্করে লেবেন্ডিস’। তাই সুমন স্যার টুনিকে প্রতিদিন বিকালে বাসায় এসে পড়িয়ে যান। এ সময় টুনির মন মোটেই পড়ার টেবিলে থাকে না, মনটা তার পড়ে থাকে বাসার সামনের খোলা মাঠটায়। এই বিকালটা যে তার খেলাধুলা আর দুরন্তপনার সময় সেটা মা-বাবা কিংবা সুমন স্যার কেউই যেন বোঝে না। মন খারাপ করা বিকালবেলায় টুনির ফাঁকিবাজি তাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আনমনে খোলা জানালা দিয়ে চেয়ে থেকে মাঠ দেখে আর ভাবেÑ মাঠটা বুঝি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অতিরিক্ত ফাঁকিবাজির কারণে সুমন স্যারের মাইর খাওয়াটা টুনির প্রতিদিনের বৈকালিক রুটিন হয়ে গেল। বাবা বাসায় থাকলে পিঠটা অন্তত কোনো রকমে বাঁচে; তবু কানের ওপর চলতে থাকে সিডর, আইলা, ফণী, আম্পান... সব। বাবা সামনে থাকলে বলেন, ‘স্যার, ছেরিডারে আমার সামনে মারুইন না যে। মনে অয়Ñ বাড়ির চোডে হেয় দুক্কু ফাইতাছে না, আমার শইল্লেই বাড়িডা লাগতাছে।’ বাবা বাসায় থাকলে তাই খুব একটা মার খেতে হয় না। কিন্তু টুনির এই পড়ার সময়টাতে প্রায়ই বাবা থাকেন অফিসে।

প্রচ- দুরন্ত আর চঞ্চল প্রকৃতির ‘লেবেন্ডিস’ টুনিকে নিয়ে মায়ের চিন্তা-দুশ্চিন্তা অন্তহীন। বাবার সঙ্গে কোনো ছুটির দিনে সেলুনে গেলে মাথার চুল ছেলেদের মতো স্কয়ার কাট দিয়ে বাসায় ফেরে টুনি। গোসল করে মা-বাবার সঙ্গে দুপুরের খাবার খায়। এরপর মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে টুনি তার প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাবা-মেয়ের কা--কীর্তি দেখে মায়ের মেজাজ চড়ে। বেশি রেগে গেলে মায়ের গলা সপ্তমে ওঠেÑ ‘এমুন বান্দর আর অস্থির পোলাপান আমি আমার জীবনেও দেহি নাই। এই বিচ্ছু রে নিয়া আমি যে কী করি! ছেরিরে ছেরা বানাইয়া রাখলে তো এমুনই অইব। সব বাপের দোষ, বাপের আসকারা পাইয়া ছেরিডা দিন দিন এমুন অইতাছে!’

মন ভালো থাকলে মা টুনিকে পাশে বসিয়ে নানা গল্প শোনায়- সত্যি গল্প, রূপকথার গল্প, রাক্ষসপুরীর গল্প; আরো কত কী! মায়ের এই গল্পের ভেতর থেকেই টুনি জানতে পারেÑ মাতৃগর্ভে সাত মাস পূর্ণ হওয়ার দুই-একদিন আগেই নাকি পৃথিবীতে চলে এসেছিল টুনি। এ কারণে জন্মের সময় তার চোখ ফোটেনি। সাত-আট দিন তুলার মধ্যে রেখে ডাক্তাররা চোখ ফোটাবার ব্যবস্থা করেছেন। এরই মধ্যে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল- ‘হুনছো গো, হাসনার ঘরো নাহি একটা ছেরি অইছে, চোখ ফুটছে না!’ আবার কেউ কেউ বলে, ‘আরে নাহ্, চোখই নাহি নাই; অক্করে বিলাইয়ের বাইচ্চার লাগান ছুডুমুডু অইছে। বাঁচব বইল্লা তো মনে অয় না।’ সে সময়টাতে ছোট্ট টুনিকে দেখার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মানুষজন আসতেই থাকত। মাঝে কয়েকদিনের জন্যে মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর ওদিকে চোখ ফোটার কয়েকদিন পর টুনি শুরু করল অবিরাম কান্না। কান্নার চোটে শরীর লাল-নীল হয়ে যেত। স্রষ্টার অপার দয়া, প্রচুর অর্থ ব্যয় আর নানাবিধ চেষ্টায় মা-মেয়ে সেবার বেঁচে গেল। মায়ের সঙ্গে কোথাও গেলে মানুষজন বলে- ‘হাসনা, এইডা তোমার হেই ছেরিডা না! চোখ ফুটছিন না, বিলাইয়ের বাইচ্চার মতো ছুডু আছিন যে।’ মা সম্মতিসূচক মৃদু হাসেন। টুনি লজ্জায় মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। বাবাকে অনেকের সঙ্গে গল্প করতে শুনে টুনিÑ ‘আমার এই পুতটারে বাঁচাইতে পুতটার ওজনের সমান ট্যাহা গ্যাছে।’

গত বছর সামনের দুটো দাঁত পড়েছে টুনির। দাঁত পড়েছে তো পড়েছেই, আর ওঠার নাম নেই। এক বছর হয়ে গেছে দাঁত আর উঠে না। এদিকে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রায় প্রতিদিনই বাছাই পর্ব চলছে। টুনি নাম লেখাল বিস্কুট-দৌড় খেলায়। হাত পেছনে বাঁধা। মাঠের অপর প্রান্তে একটা দড়িতে অনেকগুলো বিস্কুট সারি করে সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। দড়ির দুই প্রান্তে দুজন স্যার ধরে দোলাচ্ছেন। খেলার বাছাই পর্বে টিকে টুনি তো মহাখুশি। তার খেলা নিয়ে মায়েরও ভীষণ উৎসাহ। প্রথম হতেই হবে- মায়ের আদেশ।

চূড়ান্ত খেলার দিন বিস্কুট-দৌড়ের বাঁশি বাজার ঠিক আগ মুহূর্তে টুনি খেয়াল করল বিস্কুটের বদলে দড়িতে সুতাবাঁধা ছোট ছোট লজেন্স ঝুলছে। বাঁশি বাজতেই ভোঁ-দৌড়। এক দৌড়ে সবার আগেই দড়িতে ঝোলানো লজেন্সের কাছে পৌঁছে গেল টুনি। লাফ দিয়ে খপ করে লজেন্স মুখে নিয়ে ফিরতি দৌড় দেবে, ঠিক তখনই দুই দাঁতের সেই ফাঁক দিয়ে লজেন্সখানা বের হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর বারবার চেষ্টা করেও আর কাজ হলো না। ততক্ষণে অন্য প্রতিযোগীরা এন্ডিং লাইনে পৌঁছে গেছে।

মায়ের হলো মন খারাপ, টুনিরও। বাসায় ফেরার পথে তাই সোজা ডেন্টিস্টের চেম্বারে। রাশভারি ডাক্তার একবার শুধু টুনির হাঁ-মুখে টর্চের আলো ফেললেন।

Ñ এক্স-রে করে নিয়ে আসুন। যদি মাড়ির নিচে দাঁত থাকে তবে মাড়ি কেটে দাঁত বের করতে হবে। আর দাঁত না থাকলে ওষুধ লিখে দেব।

বাবা অফিস থেকে ফিরতেই মা কেঁদে অস্থির।

Ñ কী অইছে? কানতাছো কেরে?

Ñ আমার ছেরির মনে অয় আর দাঁত উঠত না।

Ñ কী কইতাছ? কুনোহানো ফইরা-টইরা গেছিন নাহি? কোন দাঁতটা ভাঙছে?

Ñ আরে না, হের সামনের দুটা দাঁত এক বছর অইছে পড়ছে, অহনো তো উডে না। তোমার কি আর কোনো দিগে খেয়াল আছে? সব তো আমার উপ্রে ফালায়া রাহ। আমার ছেরির যদি দাঁত না উডে- বুঝবা তুমি! দাঁতের ডাকতরের কাছে লইয়া গেছিলাম, ডাকতরে কইছে এক্স-রে কইরা দেখব। মাড়ির নিচে দাঁত থাকলে মাড়ি কাইট্টা বাইর করব আর ওষুধ দেব।

Ñ অ্যাঁ, কী কও না কও! মাড়ি কাইট্টা দাঁত বাইর হরন লাগব! আমার পুতের এমুন দাঁতের দরহার নাই। আমি আমার পুতটার মাড়ি কাডনের দিতামই না। দাঁত না থাকলে আমার পুতের কিচ্ছু অইয়া ফরতো না। এহ, মাড়ি কাইট্টা দাঁত বাইর হরব।

টুনি ততক্ষণে আয়নার সামনে। যদি আর কোন দিন দাঁত না উঠে তাহলে খেলায় এমন করেই আবার লজেন্স মুখ থেকে বের হয়ে যাবে কিনা তা পরীক্ষা করছিল।

Ñ আচ্ছা বাবা, আমার নানুর তো একটাও দাঁত নাই। আমারও কি নানুর মতো আর কোনো দিন দাঁত উঠত না! Ñ আরে, বেক্কল বেডি, বুইড়া মাইনষের কি আর দাঁত উডে? তুমি তো আমার বুড়ি আম্মা। এর সপ্তাহখানেক পরই টুনির বহুল প্রত্যাশিত দাঁতজোড়া উঁকি দিয়েছিল। এরপর বারবার আয়না দেখতে দেখতে টুনি আবিষ্কার করল, কথা বলতে কিংবা হাসতে গেলে তার ঐতিহাসিক দাঁতজোড়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close