জুয়েল আশরাফ

  ২০ জুন, ২০২০

রাইয়ানের সবজান্তা বাবা

কমলাপুর রেলস্টেশন। বাবার সঙ্গে রাইয়ান ট্রেনে উঠেছে। একেবারে শেষ স্টেশন ওদের গন্তব্য। প্রায় সাত ঘণ্টা জার্নি। আজ শুক্রবার। সকাল ১০টা। রোজ শুক্রবারে বাবা দাদুকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যান। আজ বাবার সঙ্গে রাইয়ানও যাচ্ছে। যে কামরাতে উঠেছে, প্রায় ফাঁকাই। সবাই বসেছে। রাইয়ানও বাবার সঙ্গে বসেছে। সিটের কাছে দু-চারজন কমবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কখন ট্রেন ছাড়বে নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে উত্তেজনা দেখাচ্ছে। কম বয়সের স্বভাবই তো তাই। সব সময় অস্থির ভাব। ঠিক রাইয়ানের মতো। কিন্তু তার এখন সব রকম দুষ্টুমি করা বারণ। বাবাবাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সাবধানের গলায় বলে রেখেছেন, সারা পথের জার্নিতে সারাক্ষণ তার সঙ্গে থাকতে হবে। কোনোরকম দুষ্টুমি করা যাবে না। যদি কথার কোনো এদিক-সেদিক হয়, তাহলে এরপর বাবার সঙ্গে কোথাও যাওয়া বন্ধ। তাইতো রাইয়ান ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ বসে আছে। চলন্ত ট্রেনে জানালার ধার রাইয়ানের প্রিয়। কিন্তু বাবা তাকে জানালার ধারে বসতে দেয়নি। যদি কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যায়! রাইয়ান বুঝতে পারছে না, এটা তো বাসা না যে, হাত কিংবা মাথা বের করে রাখলে পাশ কাটিয়ে অন্য গাড়ি চলে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটবে। তবু বাবার আদেশ চুপচাপ মেনে নিল সে, কোনো রকম যুক্তি দেখাতে গেল না।

ট্রেন ছাড়ল। বাবা রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

: মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন? আমি জানালার কাছে বসতে দিইনি তাই?

রাইয়ান বলল,

: থাক, আমি বসব না।

: খিদে লাগছে? কিছু খাবি?

: খাব না।

দুটো স্টেশন পেরিয়ে গেল ট্রেন। বাবা বললেন,

: পরের স্টেশনে মশলা-মুড়ি উঠবে। লোকটার একটা হাত কনুই থেকে কাটা। এক হাতেই দারুন মুড়ি মাখে!

একেবারে ঠিক। পরের স্টেশনে মশলা-মুড়ি। বেশ জনপ্রিয় লোকটা। কামরাতে যতজন যাত্রী ছিল, অনেকেই মশলা-মুড়ি কিনল। খটাখট খটাখট শব্দ। কৌটোর মধ্যে ক্রমাগত চামচে নাড়ার শব্দ। বাবা রাইয়ানকে মুড়ি খাওয়ার প্রস্তাব করল, রাইয়ান খেলো না।

একটা স্টেশন চলে যাওয়ার পর বাবা বললেন,

: এরপর উঠবে... শোনপাপড়ি আর কচি শসা...।

ঠিক তাই। বাবা কি ম্যাজিক জানে? নাকি সবজান্তা! রাইয়ানের বিস্ময় পেয়ে গেল।

পরের স্টেশনে ঠিকই দুজন হকার। শোনপাপড়ি। কচি শসা। অনেকে কিনল। অনেকে কিনল না।

এরকম এক একটা স্টেশন। আর বাবার ঘোষণা।

: এরপর কী উঠবে জানিস?

: কী উঠবে বাবা?

: এরপর উঠবে ঘুগনি। এই খাবারের খুব ডিম্যান্ড! বাইরে তুই কোথাও এরকম ঘুগনি পাবি না! তোদের স্কুলেও না।

: তাই নাকি বাবা?

: হ্যাঁ। খাবি?

: খাব। কিন্তু তুমি না বলো বাইরের খাবার খেলে পেটে ব্যথা করবে...?

রাইয়ানের কথা শেষ হলো না। ট্রেন থামল। খুব লম্বা ও বয়স্ক একজন লোক উঠলেন। মাথায় ঘুগনির ইয়াব্বড় গামলা। যাত্রীরা যেন সব ঝিমুচ্ছিল। ঘুগনির টের পেয়ে জেগে উঠল।

: ইয়াছিন ভাই এদিকে। আমাদের দুটো লাগবে।

ঘুগনিওয়ালার নাম ইয়াছিন। তার নাম ডাকতেই লোকটি বাবার কাছে চলে এসেছে। বাবা তার নামও জানে! রাইয়ান খুবই অবাক হচ্ছে।

বাবা ঘুগনি নিলেন। রাইয়ানের দিকে আরেকটি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, খেয়ে দেখ কেমন মজা!

রাইয়ান নিল। সত্যিই দারুণ স্বাদ। খেতে খেতে রাইয়ান জিজ্ঞেস করল,

: এরপর কোন হকার উঠবে বাবা?

: এর পরের স্টেশনটা ফাঁকা যাবে। তারপর...।

: তারপর কী?

: পেয়ারাওয়ালা।

পরের স্টেশনে রাইয়ান দেখল বাবার কথা ঠিকই। একজন যুবক বয়সি ছেলে পেয়ারা নিয়ে উঠল। আগ্রহ নিয়ে অনেকেই কিনল। কচি পেয়ারা কেটে সঙ্গে মসলা-লবণ মাখিয়ে দিচ্ছে। রাইয়ানের দাঁতে ব্যথা। পেয়ারা চিবাতে পারবে না। তাই বাবা খেতে বলতেও নিল না।

নিজের ছন্দে চলছে ট্রেন। পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, ডোবা, ধানখেত, সরু রাস্তা। একটি পুকুরে দুটি ছোট্র ছেলে ন্যাংটা হয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে। বাকি ছেলেগুলো পুকুরের কাদামাটি ছোড়াছুড়ি খেলায় ব্যস্ত। এই দৃশ্যে খুব মজা পেল রাইয়ান। বাবা বললেন,

: এখন পরপর তিনটা স্টেশনে কোনো হকার উঠবে না।

রাইয়ান কৌতূহলী হয়ে বলল,

: তারপর?

: তারপর বাদাম ছোলাবুট চানাচুর ভাজা।

: ছোলাবুট ভাজা আমার খুব পছন্দ। কিন্তু দাঁতে ব্যথা।

প্রায় ২৫ মিনিট পর তাই উঠল। বাদামওয়ালা-চানাচুরওয়ালা দেখা যাচ্ছে। বাবা বললেন,

: বাদাম খেলে দাঁতে ব্যথা পাবি না। বাদাম নিবি?

: না। যদি ব্যথা লাগে!

: আচ্ছা থাক।

রাইয়ান বলল,

: এরপর কোন হকার উঠবে বাবা?

বাবা চিনাবাদাম খেয়ে শেষ করে খালি ঠোঙাটা চলন্ত ট্রেনের জানালার বাইরে ছুড়ে দিয়ে বললেন,

: এরপরের স্টেশনেই শুনবি গান। গান শুধু গান।

: তাই নাকি?

: হ্যাঁ। এক অন্ধ মাঝবয়সি মানুষ। সঙ্গে ছোট্র একটা ছেলে নিয়ে গান গাইবে।

: পরের স্টেশনে ট্রেন থামল। কয়েকজন যাত্রী নামল। কয়েকজন উঠল। আর উঠল সেই অন্ধ গায়ক। সঙ্গে ১০-১১ বছরের একটি ছেলে। পরনে মলিন জামাকাপড়। অন্ধলোকটি বেহেশতে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে কিছু ইসলামিক গজল গান গেয়ে শোনাল। অনেকেই টাকা দিল। অনেকেই দিল না। যারা দিল না, অন্যদিকে মুখ ফিরে থাকল। রাইয়ান বাবার কাছ থেকে একটি ১০ টাকার নোট নিয়ে ছেলেটির হাতে দেয়। দুটা স্টেশন পরে অন্ধ লোকটি আর সঙ্গে ছোট ছেলেটি নেমে পড়ল। বাবা বললেন,

: এরপর উঠবে তিলের খাজা।

রাইয়ান দেখল ঠিক তাই। তিলের খাজা নিয়ে হকার কামরায় উঠে হাঁকডাক দিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করতে লাগল।

: এরপরের স্টেশনে পত্রপত্রিকার হকার উঠবে।

বাবার কথার সঙ্গে এটাও মিলে গেল। বিভিন্ন ম্যাগাজিন, মাসিক কিশোরদের ম্যাগাজিন, জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রদর্শন করে হকার বিক্রি বাড়াচ্ছিল। প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকাটা নেওয়ার রাইয়ানের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। খেয়াল খুশি শিশুসাহিত্য পাতায় গল্প পড়তে পারত।

: বাবা, শেষ স্টেশন আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?

বাবা সময় দেখলেন। বললেন,

: বিশ মিনিট। তার মধ্যে আর একজন হকারই উঠবে। প্লাস্টিকের পাখি বিক্রেতা।

প্লাস্টিকের পাখি বিক্রেতা ট্রেনে উঠে খুব মজা করে কথা বলছিল। একটি নীল পাখিকে শূন্যে ছুড়ে দিল। পাখিটা... আশ্চর্য! পাখিটা গিয়ে বসল এক যাত্রীর কাঁধে! হকারটি ছড়া কাটতে লাগল-

ওরে ও ভোরের পাখি!

আমি চলিলাম তোদের কণ্ঠে আমার কণ্ঠ রাখি।

তোদের কিশোর তরুণ গলায় সতেজ দৃপ্ত সুরে

বাঁধিলাম বীণা, নিলাম সে সুর আমার কণ্ঠ পুরে।

চমকে গেল রাইয়ান। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ছড়া-কবিতা! এই হকার কীভাবে জানল জাতীয় কবির কবিতা! তার মানে এই হকার স্কুলে পড়েছিল। তবে তো তার অনেক ছড়া-কবিতা মুখস্থ।

পরের স্টেশনেই নেমে গেল প্লাস্টিকের পাখিওয়ালা।

শেষ স্টেশনে পৌঁছাল ট্রেন। যাত্রীরা নামল। বাবা নামলেন। সঙ্গে রাইয়ানও। বাবা বললেন,

: ট্রেন জার্নি কেমন লাগল রাইয়ান?

: দারুণ লেগেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন।

: বল।

: বাবা তুমি সবকিছু আগে থেকেই জানো কীভাবে? কোন স্টেশনে কখন কে উঠবে বলতে পারলে কীভাবে? তুমি কি সবজান্তা?

এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না বাবা। মুখে রহস্যময় হাসি হাসলেন শুধু। রাইয়ানের মনে এলো তার বাবা ঠিকই সবজান্তা। আগে থেকেই সবকিছু জানেন। ঠিক ঠিক বলতেও পারেন। এজন্যই বাবা জবাব না দিয়ে রহস্য করে হাসলেন।

প্ল্যাটফরমের বাইরে ছোট ফুফু আর ছোট চাচু অপেক্ষা করছিল। হাত নেড়ে ইশারা করল। ছোট ফুফু জড়িয়ে চুমু-আদর খেলেন রাইয়ানকে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

: কেমন আছিস রাইয়ান?

রাইয়ান চিন্তিত হয়ে বলে,

: খুব ভালো। কিন্তু একটা প্রশ্ন ফুফু।

: কী প্রশ্ন?

: বাবা কি সবজান্তা? সবকিছু আগে থেকেই বলতে পারেন?

: কেন, কী করেছে তোর বাবা?

: প্রতিটা স্টেশনে কোন হকার উঠবে-নামবে, সব যেন বাবার আগে থেকেই জানা। বাবার কথার সঙ্গে সবকিছু ঠিক ঠিক মিলে যায়। আমার মনে হয় বাবা সবজান্তা।

এই কথায় বাবার সঙ্গে ছোট ফুফু চাচু একসঙ্গে হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে ফুফু বললেন,

: তোর বাবা এই ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করেন। এজন্য সবকিছু জানা। বোকা ছেলে, সামান্য ব্যাপারটা বুঝলি না!

দ্বিতীয়বার সবাই একসঙ্গে আবার হেসে উঠল।

বোকার মতো রাইয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই সামান্য কৌশলটা এতক্ষণে বুঝল! সে মনে মনে ভাবে, বাবা সবজান্তা হলেই ভালো হতো। আগেভাগেই সব বলে দিত আর সে বিস্ময়ের সঙ্গে মজা নিতে পারত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close