শরিফুল ইসলাম

  ২১ মার্চ, ২০২০

ইবু ইলু দিলু এবং চিকুদের মুক্তির লড়াই

সময় ১৯৭১ সাল! প্রধান শহর থেকে শত মাইল দূরে একটি পল্লীতে বাস করত ইবু, ইলু, দিলু আর চিকু। এরা সবাই প্রায় সমবয়সি হয়তো দু-এক বছর কমবেশি হতে পারে। তবে এদের মাঝে সবার বড় ইবু। ইবুর বয়স ১৭ বছর, ইবুদের পরিবারের বড় ছেলে ইবু নিজেই! পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় বাবার অসুস্থতার কারণে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়েছে ইবুর কাঁধে। ইবুকে তাই পাঁচ সদস্যের পরিবারটা কাঁধে নিয়ে দৌড়াত পৃথিবীর পথে, ভাঙতে হয় পাহাড়ের পথ, খনন করতে হয় অতল সমুদ্র! ডুবে থাকতে হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রমে, এভাবেই চলছে শেষ ছয় বছর।

আবার ইলু আর দিলু আপন দুই ভাই, এদের পরিবারেও অভাব-অনটন লেগেই থাকে! বাবা ভবঘুরে শুধু জুয়ার মধ্যে পড়ে থাকে! কাজকর্ম ছেড়ে দিছে সেই এক যুগ আগেই। ইলু আর দিলুদেরও সাত সদস্যের পরিবার, ইলু আর দিলু ছাড়াও পরিবারে বড় এক ভাই আর তার ছোট দুই বোন আছে। বড় ভাই বিয়ে করে নিজরে সংসার গোছাচ্ছে এবং বোন দুটোর বিয়ে হয়েছে দিন কয়েক হলো তাইতো এখন ইলু আর দিলু দিন-রাত খেটে দুমুঠো ভাত সংগ্রহ করে। আর চিকু হলো বাবাহারা সন্তান, সেই ছোটবেলায়ই বাবাকে হারিয়ে এতিম হয় চিকু। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ চিকুর বয়স ১৫। চিকু এখন ভালোমন্দ সবই বুঝে, তাইতো বেরিয়ে পড়েছে ভাগ্যের সন্ধানে, মাকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না।

ইবু ইলু দিলু এবং চিকু এরা সবাই আমার মতে, একেকটি বীর সন্তান, দরিদ্রতা তাদের বইয়ের ব্যাগের পরিবর্তে তুলে দিছে পরিবার নামক বোঝা। তারা রচনা করছে নিজেদের জীবন এবং তৈরি করছে নিজেদের প্ল্যাটফরম। ইবু ইলু দিলু আর চিকু এরা চারজনে ছোট্ট শহর হামিদপুর ব্রিজের নিচ থেকে নানা ধরনের জিনিসপত্র ঝিনাই খালের এপাড় পর্যন্ত আনা-নেওয়া করে, যার বিনিময়ে তারা একেকজনে প্রতিদিন এক থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারে। কেউ আবার দুই টাকাও করে কোনো কোনো দিন। ইবু ইলু দিলু এবং চিকু এই চারজনের মধ্যে সবার বড় ইবু, তাইতো ইবু এদের দলনেতা। ইবুর কথামতো সবাই কাজ করে আর কারো কোনো কিছু আনা-নেওয়ার থাকলে সবাই ইবুকে বলে যায়, ইবু আবার সবাইকে বলে আর চলে যায় হামিদপুর ব্রিজের নিচে না হয় বংশাই নদীর পশ্চিম পার্শ্বে ঝিনাই খালের পাড়ে। এভাবেই চলতে লাগছে এই চারজনের সংগ্রামী জীবন।

এক দিন খুব সকালে গাঁয়ের ওই ছোট্ট পথটি ধরে গঞ্জ থেকে একটু এগিয়ে ঝিনাই খালের ঘাটে যাওয়ার জন্য বংশ নদীর চর দিয়ে যাচ্ছিল ইবু ইলু দিলু এবং চিকু এই চারজন। যেতে যেতে হঠাৎ চোখ পড়ল নদীর পানা ভরা পানির দিকে, প্রথম অবস্থায় তারা স্তব্ধ হয়ে গেল, একটু ভয়ও পেল, তবে বয়সটা ১৬-১৭! এই বয়সে ভয় পেতে নেই। তাইতো ওরা চারজনে ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে লাগল! কি আছে ওইখানে? দেখতে হবে নিখুঁতভাবে! নদীর ঢালু পাড় বেয়ে একসময় তারা পৌঁছে গেল সেই পানার দিকে। পানাগুলো যে বেশ শক্ত দলবদ্ধ অবস্থায় ছিল তারা জানত এখানে কিছু একটা আছে! তারা নদীর পাড় থেকে লক্ষ্য করছিল যে, পানার দলের নিচ দিয়ে একটা মানুষের পায়ের মতো কি জানি বেরিয়ে ছিল, তাইতো তারা পানাগুলো একে একে টেনে কিনারের দিকে আনছিল এবং একসময় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।

একটি মৃত মানুষের লাশ তাও আবার গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। বুকের মধ্যে চার-পাঁচটা গুলির দাগ। খুব ভয়ংকরভাবেই মারা হয়েছে! কিন্তু কে এবং কারা এই কাজ করবে? এরা চারজনে ভাবতে লাগল! এটা তো কোনো সাধারণ মানুষের কাজ হতে পারে না! যদি ডাকাতে মারত তাহলে হয়তো বল্লব দিয়ে কুপিয়ে জখম করত আবার যদি সাধারণ কলহের জন্য হত্য করা হতো; তাহলে হয়তো দা-বঁটি অথবা লাঠি দিয়ে মারা হতো, কিন্তু গুলি করবে কে? তারা অনুমান করল, এটা অবশ্যই ভিনদেশিদের কাজ, ১৫ দিন আগেও তো লোকমুখে শুনছে যমুনা নদীতে নাকি একসঙ্গে হাত-পা বাঁধা সাতটি লাশ ভেসে গেছে, সেগুলোও তো গুলিবিদ্ধ লাশ ছিল! সেদিন আর তাদের কাজে যাওয়া হলো না! লাশটাকে টানে তুলে গ্রামের মানুষদের ডাকা হলো, তারা সবাই মিলে লাশটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দাফনের ব্যবস্থা করল।

তবে এ চারজনের মনে খুব রাগ হলো, কারা এই কাজ করছে? বিশেষ করে চিকু রাগে ফুঁসতে লাগল। কেননা চিকু ছোটবেলার বাবা হারিয়েছে, সে জানে বাবা হারানোর কী ব্যথা! যে লোকটিকে হত্যা করা হয়েছে, সেও তো কারো না কারো বাবা! যাই হোক সেদিন পার হয়ে গেল! ওরা চারজন আবার আগের মতো কাজ শুরু করল, তবে রেডিওবার্তায় নানা ধরনের সংবাদ শুনছে মানুষ! দেশে কী জানি একটা হয়েছে, দেশটা আর আগের মতো নেই। একের পর এক হত্যা, নদীতে লাশ ভেসে আসা আরো কত কী! আর রেডিওতে বারবার একটি ভাষণ বাজতেছে, ভাষণে বলা হচ্ছেÑ রক্ত, খুন, অ্যাসেম্বলি, ক্ষমতা এগুলো। এই কথাগুলো সবাই বুঝতেছে না, তবে বুঝতেছে ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায় স্বাধীনতা চায়’ এই কথাগুলো।

ইবু ইলু দিলু আর চিকু এরাও বুঝতে পারেনি প্রথমে এই কথাগুলো অবশ্য তার কয়েক দিন পর ছাব্বিশে মার্চে তারা বুঝতে পারে দেশে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, অসহায় মানুষদের হত্যা করছে! দেশে বিশাল গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং কী, কিছুদিনের মধ্যেই তাদের গঞ্জেও হয়তো এসে পড়বে পাক বাহিনী। এসে হয়তো সবাইকে হত্যা করবে, মেরে ফেলবে সবাইকে। আর এসব ভয়ে গ্রামের মানুষ পালাতে শুরু করছে, শুরু করছে নানাদিকে দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু ইবু ইলু দিলু আর চিকু এখনো স্তব্ধ! তারা আর আগের মতো নেই, সেই নদীতে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়ার পর থেকে কেমন জানি সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। কয়েক দিন পর এক দিন খুব সকালে তারা চারজন মিলে কিছু মালামাল আনা-নেওয়া করছে! তখন তারা পথচারীদের কাছে শুনতে পেল যে, গঞ্জে নাকি এক দল মিলিটারি এসেছে! তারা গ্রামে গ্রামে যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর ধরে নিয়েই গুলি করে মারছে। এটা শুনে এর চারজন বলে উঠল এসব কী হচ্ছে? এরা চারজনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল কাজকাম বাদ দিয়ে বাড়ির দিকে। আর বলল, কিছু একটা করতে হবে, চল সবাই! আমরাও মিলিটারিদের বিরুদ্ধে লড়াই করব, এই লড়াই হবে আমাদের মুক্তির লড়াই!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close