তারিক জামিল

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

অবেলার গল্প

সময়টা রাতের শেষ প্রহর। বাইরে বড্ড শীত পড়েছে আজকাল। শহরের সবাই ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে এতক্ষণে। উষ্ণতায় তপ্ত হচ্ছে কম্বল-কাঁথা। জেগে আছে কেবল পুলের নিচের অসহায় ছেলেটা। নাম মজিদ। বয়স এগারো ছুঁই ছুঁই। শীতের প্রকোপ ওর ঘুমটা কেড়ে নিয়েছে। পাশের নদী বেয়ে থেকে থেকে ঠা-া বাতাস ধেয়ে আসছে। বরফের মতো গুঁড়ি গুঁড়ি শীতল ফোঁটা, সঙ্গে জমাট গন্ধ। তবু ওর বিরক্তি লাগছে না। সয়ে গেছে সবটা এত দিনে। তবে ঠা-া বেশ কষ্ট দেয়। রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। শুয়ে আছে পাতলা কাঁথাটা জড়িয়ে। গুটিশুটি অনেকটা। কাচুমাচু দেহ। দাঁতের পাটি দুটো বিড়বিড় শব্দ তুলছে। পাশেই শুয়ে আছে ছোট্ট ভাইটা। বয়স তিন বছর। প্রায় রাতেই কেঁদে ওঠে। কখনো ভয়ে, কখনো ঠা-ায়। বাবা-মায়ের ব্যর্থ সান্ত¦নার হাত কপালে বুলোয় ওর। ঘুম পাড়ায়। আবারও ঘুম ভাঙে। ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে তবু। মজিদের বাড়ি নেই। ঠিকানা নেই। দিন কাটাবার, রাত পোহাবার ব্যবস্থা নেই। ডাস্টবিনটাই ওর দিনের আবাসস্থল, আর এই পুলটাই রাত পোহাবার জায়গা। বছর দুই পেরোতে চলল, কখনো এখান থেকে সরে যায়নি। ডাস্টবিনের পচা খাবার খেয়ে দিন পার করে। নিজেকে নিয়ে মোটেই ভাবনা নেই। যত চিন্তা, সব ছোট্ট ভাই ঘিরে। ছোট্টকে কিছু খাওয়াতে পারলে আর খাওয়া লাগে না। পেটভরে যায় তাতেই।

মজিদ উদাস চোখে তাকায় এদিক-ওদিক। কাউকে খুঁজে ফেরে সারাক্ষণ। মানুষের কোনো জটলা দেখলে দৌড়ে ছোটে সেদিকে। ভিড় ঠেলে উদ্ঘাটন করে রহস্য। আবার শূন্য বুকে ঊর্ধ্বশ^াসে ফিরে আসে পুলের নিচে। মাঝেমধ্যে বড্ড ভয় হয় ওর ছোট্টকে নিয়ে। কখনো চোখের আড়াল হতে দেয় না তাই। আগলে রাখে সারাটা সময়। কখনো-সখনো পুলের ওপর আসে। ওর পরম সঙ্গী নদীর জল। সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। তা মিশে নদীর জলে একাকার হয়। পৃথিবীতে ওর কোনো সান্ত¡না নেই। কান্নাই ওর সান্ত¡না। চোখের অশ্রুই ওর হাসি, কষ্টের উপশম।

নদীর পাশের গ্যারেজের মালিক সোহাগুর রহমান সোহাগ। লোকে তাকে ‘গু-া সোহাগ’ নামে চেনে। লোকটার স্বভাব বিশেষ সুবিধের না। নদীর কালো জলের মতো ভেতরটা যেনো কালো। খিটখিটে স্বভাবের অনেকটা। গড় গড় করে মুখ চলতে থাকে সারাক্ষণ। অনেকটা বাচাল প্রকৃতির। তার নজরে পড়ে মজিদের চেহারা। এক দিন ডেকে পাঠায় গ্যারেজে।

নাম কী?

মজিদ।

কাম করবি?

কী কাম?

গ্যারেজের কাম।

মানে?

আগ্যায় জুগ্যায় দিবি আর কী, পারবি না?

হ, পারব তো।

পরদিন থেকে মজিদ কাজে লেগে যায় সোহাগের গ্যারেজে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে। বড় বড় টায়ার ওর গলায় ঝুলিয়ে দেয় সোহাগ। সেগুলো বয়ে বেড়ায় মজিদ। জলে সাফাই করে। পোড়া মবিলের কালো ধোঁয়ায় ওর নাক জ¦লে। ছোট্ট মানুষ। আর কত পারে! দিন শেষে হাতে পায় কুড়ি টাকা। দুই রুটি খেয়ে পার করে শ্রমের দিন। এক দিন মজিদের শরীরটা বেশ ন্যুয়ে পড়ে। শোয়া থেকে উঠতে পারে না তেমন। কাজের বড্ড চাপ তার ওপর। গ্যারেজের সব কাজ যেন ওর ওপর চাপানো হয়। স্থির করে, দোকানে আর যাবে না। কুড়িয়ে খাবে। নদীর ঘোলাজলের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মিতালী করবে। কিন্তু বেলা বাড়তেই সোহাগ হাজির।

মজিদ! এহোনও ঘুমাস? ওঠোস না ক্যান?

দাদা! আমার শরীলডা তেমন ভালো নাই, বল পাইতেসি না আইজ। আমারে মাফ করেন। কাইলকে কাম করবা নে।

সোহাগের মাথায় রক্ত উঠে যায়। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে সে। মাফ না করে কলার ধরে নিয়ে আসে দোকানে। ভারী ভারী কাজ মাথায় দেয়। অসুস্থ মজিদ ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটায়। কাজে খামি দেখলেই সোহাগ গড়গড়িয়ে ওঠে। মাকে তুলে গালি দেয়। মজিদ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। হাত-পা অচল হয়ে পড়ে। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। কাঁদতে কাঁদতে নাক-মুখে এক করে ফেলে জল। হারানো স্মৃতি ওর ছোট্ট বুকে হানা দেয়। দূরের আকাশ দেখে, নদী দেখে। সবকিছু গাঢ় ধোঁয়া মনে হয়। সময় যত গড়ায়, সোহাগ ততই চটে। বেলা শেষে হাতে যা ধরিয়ে দেয়, তাতে পোষায় না। রীতিমতো মজিদ বকাবকির সঙ্গে মার খায়। ওর শরীরের কালো চামড়ায় দাগ পড়ে। ব্যথার পর ব্যথার পাহাড় জমে। মজিদ সোহাগের হাতে ধরা। না ছাড়তে পারে, আর না শান্তিমতো করতে পারে।

দিন শেষে ক্লান্ত শরীর বিছানায় লুটায় মজিদ। গভীর ঘুমে চৈতন্য। মেঘের আস্তরের মতো ঘুম আস্তর বাঁধে ওর চোখে। মুহূর্তেই যেন রাত ফুরোয়। সূর্যের গরম রোদে ঘুম ভাঙে মজিদের। পুরো শরীরে ঘাম। জবুথবু অবস্থা। পাশে চোখ ফেরাতেই দেখে মিথু নেই। মিথু গ্যারেজ চেনে। যেতে পারে সেদিকে। দৌড়ে যায় তাই গ্যারেজে। এখানেও নেই। আশ্চর্য! দোকান বন্ধ। বছরে এই প্রথম দোকান বন্ধ দেখে মজিদ। ফিরে আসে পুলের নিচে। নেই এখানেও। পুলের ওপর? সেখানেও নেই। পুলের ওপর থেকে দূরে তাকায়। তন্ন তন্ন করে খোঁজে চারপাশে। ছুটে যায় বাজারের দিকে। কাঁচা বাজারে, অলিগলিতে, দোকানে দোকানেÑ হন্নে হয়ে বেড়ায়। কোথাও নেই। আবারও আসে পুলের নিচে। পাগলের মতো খোঁজে। লাভ হয় না। কোথাও মেলে না মিথু। ছোট্ট বুকটা হাহাকার করে ওঠে। হৃদয়ের শক্ত মাটিতে বেদনারা বলের মতো আওয়াজ তোলে। এক আকাশ অশ্রুর বন্যা চোখ থেকে বেরিয়ে আসে একসঙ্গে। চিৎকার তোলে। গলা ফাটায়। ডাকেÑ মিথু! মিথু! ওর আহাজারির স্বর পুলের দেয়ালে বাজে। গর্জে ওঠে চতুর্দিকে মিথু নামের ধ্বনি। তবু মিথু নেই, কোত্থাও নেই।

পুলের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে নিরুপায় মজিদ। চোখে শ্রাবণধারা। কণ্ঠে শ্লেষ্মাযুক্ত কান্না। কেঁদেই চলে অবিরত। সান্ত¡না দেওয়ার মতো নেই কেউ। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে না কেউÑ‘বাবা! কাঁদিস না। আমি তো আছি। দেখিস! সব ঠিক হয়ে যাবে। মিথুকে পেয়ে যাবি। পেয়ে যাবি তোর হারানো মাকেও। তোদের আর কষ্ট থাকবে না।’ দিন শেষে সন্ধে নামে। মজিদ কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে, টের পায় না। ঘুম ভাঙে গভীর রাতে। সবকিছু নীরব-নিস্তব্ধ। নিরবতার পর্দা চিরে মাঝেমধ্যে হনহনিয়ে ছুটে চলে কার্গো। লাইটের আলোর এক ঝলক পুলের নিচেও গড়ায়। দেখে সব শূন্য। পৃথিবী শূন্য। আকাশ শূন্য। ভাইহারা মজিদের বুক শূন্য। মজিদ উঠে দাঁড়ায়। গিরায় বল নেই। পেটে দানাপানি নেই। তারপরও দাঁড়ায়। দুঃখের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। দুটো কাঁথা আর একটা চট বস্তায় ভরে কাঁধে নেয়। পুলের ওপর উঠে আসে। হাঁটতে থাকে পুলের শেষ মাথা পর্যন্ত। থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ। পুলের ওপর ওর বড্ড রাগ, বেশ অভিমান হয়। একদিন পুলকে ভালোবেসেই আশ্রিত হয়েছিল ওরা তিনটে প্রাণ। মজিদ, মিথু আর ওদের মা। মা এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে কিছু জোটাতেন। তখন ওদের খুব শান্তি ছিল। থালাভর্তি ভাত খেতে পেত। মা খেত, মজিদ খেত; খেত ছোট্ট ভাই মিথু। দিন শেষের রাতটা পুলের নিচেই কাটত। ওদের ছোট্ট একটা টং ছিল। তাতে খুব শান্তিতে দিন কেটে যেত।

মজিদ অভিমানী চোখে পুলের দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। ওর সিক্ত ঠোঁট দুটি কেঁপে ওঠে বারবার। আরো কিছু জল গড়ায় চোখ থেকে। ওর স্মৃতির পাতায় ঝুলন্ত মহাকাশ। শূন্য যার সব দিগন্ত। শুধু আছে হাহাকার আর বেদনার প্রস্তর। মনে পড়ে এক সকালে মা বেরিয়েছিলেন কাজের খোঁজে। সকাল গড়ায়, দুপুর গড়ায়, সন্ধে নামে। কিন্তু আর ফেরেননি মা। কত পথ চেয়ে রইল! কিন্তু আর ফেরার নাম নেননি তিনি। এরপর গত হলো বছর দুই। তবু মেলেনি তার খোঁজ। মজিদ তখন ‘মা! মা!’ করে সারাটা গলি কাঁপিয়েছিল। ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়েছিল। সেই অশ্রু শুকোবার আগেই আজ হারালো মিথুকে। নিঃস্ব মজিদ, নিঃস্ব মজিদদের জীবন পৃথিবী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close