আবদুস সালাম

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

শীত ঋতু

তোমরা সবাই জানো আমাদের দেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাস পরপর এই ঋতুর পালাবদল হয়। শীত আমাদের পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। প্রতিটি ঋতুর মতোই শীতকাল তার নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে আসে শীত। শীতের কথা স্মরণ করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকে শীতার্ত মানুষজন। সারি সারি খেজুরগাছে ঝুলতে থাকা রসের ভাঁড়। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রসের ভাঁড়ে মৌমাছিদের নৃত্য। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর নয়নাভিরাম দৃশ্য। এটা শীত ঋতুর একটা সাধারণ চিত্র। এ ছাড়া শীত ঋতুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা তোমরা সবাই জানো।

শীত আমাদের সবার প্রিয় ঋতু। তোমরা অনেকেই জানো এ ঋতু ফুল-ফসলে সমৃদ্ধ। তাই শীতকাল অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাংলার রূপবৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গাজুড়ে শীতের অবস্থান। শীতের সকালের রূপ অন্য সব ঋতু থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হেমন্তের দিনগুলো শেষ হতে না হতেই শীতবুড়ি এসে প্রকৃতিতে হাজির। কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন-মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস। পৃথিবী কেমন যেন জড়সড় হয়ে যায় শীতে। সূর্যের আলোয় সবুজ মাঠগুলোকে মনে হয় কে যেন মুক্তার দানা ছড়িয়ে রেখেছে। সেই দানাগুলো থেকে রামধনুর সাত রঙের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখলে পরাণ জুড়িয়ে যায়। শর্ষের খেতগুলোকে মনে হয় হলুদের সাগর যেথায় হিমলে হাওয়া ঢেউ খেলে যায় প্রতিনিয়ত। মাঠে মাঠে হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর ঢাকা থাকে হলুদে চাদরে। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখ জুড়াতে জুড়ি নেই সরিষা ফুলের। এই ফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দেয় ভিন্ন মাত্রা, ঠিক কৃষকের মনে জাগায় স্বপ্ন। এ ছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, কুমড়া, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, শসা, মিষ্টিকুমড়ার খেতগুলো দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এসব হাটবাজার থেকে লোকজনরা ব্যাগভর্তি করে শীতের সবজি নিয়ে বাসায় ফেরেন। এত সব পুষ্টিকর শাকসবজির পসরা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।

এখন আসি ফুলের কথায়। শীত মৌসুমে ফুলকাননের যেসব ফুল মানুষের মনকে মুগ্ধ করে তার মধ্যে ডালিয়া অন্যতম। লাল, চকোলেট, হলুদ, সাদা, গোলাপি, বেগুনি প্রভৃতি বর্ণের ডালিয়ার পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমৎকার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। কৃষ্ণকলি শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল। এ ফুল সাদা আর গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। শীত মৌসুমের আরেক ফুল কসমস। এ ফুল সাদা, লাল বা গোলাপি বর্ণের হয়। এছাড়া শীত মৌসুমের আরো যেসব জনপ্রিয় ফুল রয়েছে তার মধ্যে গ্যাজানিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, অ্যাস্টার, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, সূর্যমুখী, পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস পিটুনিয়া অন্যতম। বারান্দা বা গ্রিলে ঝোলানো টবে লাগানোর জন্য পিটুনিয়া, ন্যাস্টারশিয়াস, অ্যাস্টার, ভারবেনা ইত্যাদি উত্তম। গ্রিলে লতিয়ে দেওয়ার জন্য নীলমণি লতা, মর্নিং গ্লোরি, রেল লতা, সুইট পি ভালো। এসব ফুলের রূপ সৌন্দর্য, পরশ মানুষের মনে স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়।

শীত মানেই হরেক রকম ফলের বাহার। শীত ঋতুর কমলা, কুল, সফেদা, জলপাই ইত্যাদি ফল মুখের স্বাদকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এ ঋতুর জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি ডালিম। এ ফল কারো কাছে বেদানা, কারো কাছে আনার নামে পরিচিত। শীতের ফলের রাজা বলা হয় কমলাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে কমলার চাষ হয়। এ ঋতুতে আরো যেসব সুস্বাদু ও উপকারী ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কুল, জলপাই, আমলকী অন্যতম।

শীতকালে গ্রামের মজাই আলাদা। তোমরা যারা শীতকালে নিয়মিত গ্রামে যাও তারা হয়তো বুঝতে পারছ এর প্রধান কারণ পিঠাপুলি। শীত এলে বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। বাংলার শীতকাল আর পিঠা যেন একসূত্রে গাথা। কৃষকের ঘরে হেমন্তে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পিঠা তৈরির কাজ। চলতে থাকে তা পুরো শীতকালজুড়ে। বেশির ভাগ পিঠাই মিষ্টিপ্রধান, কিছু পিঠা ঝালজাতীয়। তবে যে পিঠাই তৈরি করা হোক না কেন, পিঠা তৈরির মূল উপকরণ চালের গুঁড়া। এক এক অঞ্চলে এক এক রকমের পিঠা তৈরি হয়। একই পিঠার নামও আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন। তবে এমন কিছু পিঠা আছে, যা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বানানো হয়। যেমন- চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, পুলিপিঠা, নকশিপিঠা, তেলেপিঠা ইত্যাদি। শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলোÑ চিতই, পাকান, পাটিসাপটা, ভাপা, পুলি, ম্যারা, তেলেভাজা, ফুলঝুরি, নকশি, গোলাপফুল, দুধপিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, ঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, খান্দেশা, পিঠা, পাতা পিঠা, গুলগুলা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।

এত গেল শীতের প্রকৃতি ও ফুল-ফসলের কথা। এখন আসি শীতের প্রভাব প্রসঙ্গে। তীব্র শীতের ভিন্নতার কারণে গ্রাম ও শহরে এর প্রভাবেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তাই শীত কারোর জন্য হয় আশীর্বাদ আর কারোর জন্য হয় কষ্টের। শহরে যারা কংক্রিটের দালানে বসবাস করেন তাদের কাছে শীত আশীর্বাদ। দিনের বেলায় তারা গরম পোশাক-পরিচ্ছদ পরে চলাফেরা করে। রাতের বেলায় লেপ-কম্বল গায়ে দিয়ে পরমসুখে ঘুমে ঘুমিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীতকাল বড় কষ্টের বার্তা নিয়ে আসে। বেড়া, ইট কিংবা জানালা-দুয়ারের ফাঁক দিয়ে শীত প্রবেশ করে শোবার ঘরে। তখন সব বয়সি মানুষ তীব্র শীতে কাঁপতে থাকে। শীতের তীব্রতা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তাদের থাকে না। অসহায় ও হতদরিদ্রের কষ্ট দিন দিন বাড়তেই থাকে। যারা খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাত, বাস ও রেলস্টেশনে কিংবা নদীর পাড় ও রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে বসবাস করেন তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। তারা ছেঁড়া কাঁথা, কম্বল ও পাটের বস্তা দিয়ে শরীর আবৃত করে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন। তারা অতি সহজেই ঠা-া, জ্বর, সর্দি, কাশির মতো শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সূর্যের কিরণই যেন তাদের শীত থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। অনেকে খড়-বিচালি, ডালপালা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। শুধু মানুষই নয় গৃহপালিত ও বনের পশুপাখিরাও তীব্র শীতে কাতর থাকে। সড়কপথে প্রায়ই কাকসহ নানা ধরনের পাখির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় দেখা যায়, সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে যায় শীতার্ত অসহায় গরিব-দুখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে। যার যেটুকু সাধ্য তা নিয়েই চেষ্টা করব অসহায় শীতার্ত মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে।

তোমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছ যে, শীত ঋতুর প্রভাবে প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের মাঝে কিছু ক্ষতিসাধন হলেও এ ঋতু আমাদের কৃষিকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের জীবনকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে তোলে। শীতকাল আমরা মনের মতো করে উপভোগ করি। তাই আমরা বলতে পারি আর্থসামাজিক উন্নয়নে শীত ঋতুর গুরুত্ব আমাদের দেশে অপরিসীম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close