শামীম শিকদার

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

গ্রামের নবান্ন উৎসব

তাইফ নাক ডেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে, তবু ঘুম থেকে ওঠার কোনো নাম নেই। এ অভ্যাসটি তার বেশ পুরোনো। তবে শীতকাল এলে যেন তা আরো বেশি স্থায়ী হয়ে যায়। এখন অগ্রহায়ণ মাস, হেমন্তের শেষ; শীত ছুঁইছুঁই বলে। এ সময় বাড়িতে অনেক কাজ থাকে। নতুন আমন ধান গোলায় ওঠানোর জন্য চলে ব্যাপক প্রস্তুতি। ধান কাটা, ধান মড়াই, ধান সিদ্ধ, ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার প্রস্তুতি গ্রামের সবার মতো কোনো অংশ কম নয় তাইফের পরিবারের। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নতুন ধান সেদ্ধের কাজে লেগে যায় তার মা। ভোরে ফজরের আজান দেওয়ার সময় দু-এক মণ সেদ্ধ করা হয়ে যায়। ধান সেদ্ধ শেষে শুকাতে দেওয়ার সময় তাইফকে তার মা ঘুম থেকে উঠে কাজে সহযোগিতা করার জন্য বলে। মার মুখে কাজের কথা শুনে হালকা শিশিরস্নাত শীতে কম্বলের ভেতরে গরম উষ্ণতায় বাহিরের ঠান্ডা কনকনে বাতাসে যাওয়ার আগ্রহ মোটেও হয় না। তাই সে তার মার কথায় তেমনভাবে সাড়া না দিয়ে আরো শক্ত করে কম্বলটি জড়িয়ে ধরে মাথা কম্বলের ভেতরে নিয়ে শুয়ে আছে। চোখে কোনো ঘুম নেই, তবু কেন জানি কম্বলের গরম উষ্ণতা ছেড়ে একেবারে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। বাহির থেকে বারবার তাইফের মায়ের মুখ থেকে নাম ধরে ডাকের শব্দ বের হয়ে আসছে। সেও জানে মার কথাকে অবজ্ঞা করে কোনো উপায় নেই। একটু পর হয়তো তার বাবার কাছে অহেতুক নালিশ চলে যাবে। বাধ্য ছেলের মতো শুয়া থেকে উঠে মার সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করা শুরু করল।

তাইফ বরুন উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ি থেকে ক্ষাণিকটা দূরে বলে স্কুলের উদ্দেশে একটু আগে বের হতে হয় তাকে। পথে তার নিত্যসঙ্গী হয় পাশের বাড়ির ইভনাত। দুজন একসঙ্গে নিয়মিত স্কুলে যায়। সবার বাড়িতে কাজের বেশ ধুম বলে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেকটা কমে গেছে। তবে অন্যদের থেকে আলাদা তাইফের মা। ছেলের পড়ালেখার ব্যাপারে বরাবরই সচেতন। ছেলেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়া সত্ত্বে অন্যান্য উচ্চ পরিবারের মতো করেই বড় করতে চান নিজের আদরের ছেলেকে। শুধু পড়ালেখার পাঠ্যবইয়ের মাঝেই প্রকৃত জ্ঞান পাওয়া যায় না এটাও বিশ্বাস করেন তাইফের মা। ছেলেকে আলোকিত মানুষরূপে গড়ার উদ্দেশ্যে নিজের সঙ্গে সব কাজে দক্ষ করার লক্ষ্যে নিজের যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন।

নতুন ধান ঘরে তোলা শেষে কয়েক দিন বাদে তাইফের গ্রামে শুরু হবে নবান্ন উৎসব। সে উৎসব ঘিরে গ্রামের সবার মতো তাইফের মার অনেক পরিকল্পনা। তাইফের পরিকল্পনাও কোনো অংশে কম নয়। তাদের অধিকাংশ ধান খেতের ধানই কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধান দেখতে সে তার বাবার সঙ্গে ধান খেতে যায়। নতুন সোনালি ধান দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সুগন্ধি ধানের ম ম গন্ধ নাকের কাছে এসে জানান দেয় ধান কাটার সময় হয়ে গেছে। সকালবেলা খেতের আইল দিয়ে হাঁটার সময় কুয়াশার স্নিগ্ধ শিশিরে পা ভিজে শরীর শিরশির করে কেপে ওঠে। ধানের শিষগুলো যেন শিশিরে ভিজে আরো বেশি নবীন হয়ে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করতে থাকে। পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরের বিন্দুগুলো ধানের পাতাকে ধুয়ে সবুজের বুকে সোনালিরূপে ফোটিয়ে তোলে। খেতের পাড়ে বসে বাবার ধান কাটা দেখে ঋতু। ধীরে ধীরে কাঁচি দিয়ে ধান কাটার দৃশ্য দেখে মনে হয় কৃষকের মনে আনন্দের জোয়ারের সূচনা হচ্ছে। ধান মড়াইয়ের জন্য খালি মাঠের ঘাস পরিষ্কার করে প্রস্তুত করা হয়। নিজেরসহ পাশের কৃষকের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয় গরু। চার-পাঁচটি গরু পাশাপাশি একসঙ্গে বেঁধে তাদের নিচে দেওয়া হয় অল্প ধানসহ ধানের শিষ। ঘাস পরিষ্কার করা জমির মাঝখানে গর্ত করে বাঁশ স্থাপন করা হয় এবং তাতে গরু বাঁধা হয়। পেছন থেকে একজন লাঠি নিয়ে গরুদের তাড়া করে এবং গরুগুলো ধানের শিষের ছড়ার ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। একই জায়গার ওপর দিয়ে গরু বারবার হাঁটার ফলে গরুর পায়ের পাড়ায় ধানের শিষ থেকে ধান ঝরে মাটিতে পড়ে। তাইফের কাছে গরু তাড়ানোর ব্যাপারটি খুব মজার লাগে; তাই সে খুব আগ্রহ নিয়ে গরু তাড়ায়। মাঝে মাঝে মুখে শব্দ করে বলে, হু হুস.....হু হুট....। তার মুখের শব্দ শুনে গরু আরো জোড়ে দৌড়াতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখতে পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে মাড়াই দেওয়ার সময় আসে। তারা দূরে দাঁড়িয়ে গরু তাড়ানোর জন্য অনেকেই শব্দ করে। মাড়াই করা শেষে ধানের শিষ সরিয়ে তা থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। ধান সংগ্রহ করে তা চুলায় দিয়ে সেদ্ধ করে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। নবীন সেদ্ধ ধান থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া উঠতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে তাইফের ছোট বোন হা করে মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে বলে, দেখ ভাইয়া আমার মুখ থেকেও ধোঁয়া বের হয়।

ধান পুরোপুরি শুকানোর পর তা মেশিনে ভাঙিয়ে চাল করে টেঁকি দিয়ে চাল গুঁড়া করে পিঠা তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়। একেক দিন একেক রকম পিঠা তৈরির জন্য বায়না ধরে ঋতু। তার পিঠার তালিকায় ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা, পানতোয়া পিঠা, দুধরাজ পিঠাসহ কোনো পিঠাই বাদ যায় না। ধানের পিঠা, মুড়ি, চিড়া, খইসহ নানা খাবারের ঘ্রাণে ভরপুর ও আনন্দ উৎসবে ভরে যায় গ্রামীণ জনপদ। তাইফের মনে নতুন চালের পিঠার ঘ্রাণে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। তাদের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে পিঠার ম ম গন্ধে নতুন ধানের বার্তা পৌঁছে দেয়। নতুন ধানের অন্নে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। ওই সময় তাইফদের বাড়িতে তার ফুফুরা বেড়াতে আসেন। নানা রকমের পিঠা আর নতুন নতুন খাবারে উদ্যাপন করা হয় নবান্ন উৎসবের। অগ্রহায়ণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঋতুদের গ্রামে চলে নবান্ন উৎসের ব্যতিক্রম আয়োজন। পিঠা যেন নবান্ন উৎসবের প্রাণ হয়ে তাইফের হৃদয়ে বারবার মুগ্ধতা বিস্তার করে। তার মনে ইচ্ছা জাগে, বছরের প্রতিটি দিন যদি নবীন ধান ঘরে তোলা যেত, তবে হয়তো নবান্ন উৎসব ঘিরে আয়োজন করা হতো নতুন নতুন বাহারি পিঠার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close