শরীফ সাথী

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

টোজা বাবুর গরুর গাড়ি

নদী দিয়ে ঘেরা, থই থই জলে ভরা দ্বীপবেষ্টিতে মাঝে অবস্থিত সবুজ সমারোহে ছাওয়া নিরিবিলি পল্লী গ্রাম ‘ঝোপর গাঁ’। এ গাঁয়ের মাঝিমাল্লাহ নৌকা সারি জল তরঙ্গে নদী পারাপার। জেলেদের মাছ ধরার মহা-উৎসব চলে বছরজুড়ে। প্রকৃতির নিদারুণ বৈচিত্র্যতায় বৃক্ষের মেলায় পাখিদের কলরব মুখর করে তোলে ১২ মাস। রাখাল বাঁশির সুর নদীর তীরের মায়াবী পরিবেশ অম্লান করে প্রতিদিন। দক্ষিণা বাতাসে সবুজ মাঠে স্বর্ণ ফসল দোল খায়। চোখ ছুঁয়ে যায়, স্বপ্ন দিয়ে যায় মনের কুঠিরে। মায়া-ছায়াময় সবুজ হাসিমুখ সারাটি গ্রাম অপরূপ মনোহর সাজে সজ্জিত। ঝোপর গাঁয়ের মনোরম পরিবেশে নিরিবিলি একটি পরিবারের নির্ভেজাল সাদামাটা ছেলে টোপর। বাবা-মায়ের অতি আদরের ছেলে। বয়সে পূর্ণতা আসায় ১০ কিলো দূরের গ্রামে টোপ্পার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করল। ঘটক মারফত দেখাদেখি করে বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলো। পল্লীতে সাধারণত কোনো অনুষ্ঠান হলে সপ্তাহজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দুটি গ্রামেও যেন বিয়ের ধুমে ঘুম হারামের মতো। সাজ সাজ রব পাড়া প্রতিবেশী গ্রামজুড়ে। পুরো সপ্তাহজুড়ে দাওয়াতি কার্যক্রম চলে, আত্মীয়স্বজনদের বিয়েতে আসার নিমন্ত্রণ পাঠানো লোক মারফত।

গায়েহলুদ। দুই ঘটকের মাধ্যমে এ গ্রাম হতে ও গ্রাম, ও গ্রাম হতে এ গ্রাম, ছেলে এবং মেয়ের গায়েহলুদের হলুদ রঙের পোশাক পাঠানো হলো। গায়েহলুদের দিন সব আত্মীয়স্বজনে ভরে উঠল বিয়েবাড়িতে। বিকালবেলায় হাঁড়িভর্তি ক্ষীর রান্না হলো। রীতি অনুযায়ী রাত্রে বসবে মুখে ক্ষীর দেওয়া পর্ব। সন্ধ্যার পরই পাড়া গাঁয়ের সব পরিবারের লোকদের ক্ষীর দেওয়ার জন্য ডাকানোর ব্যবস্থা আছে। সাধারণত মেয়েরা এ কাজ করে থাকে। একেক বাড়ি যায় আর বলে, ও বুবুরা, ও ভাবিরা টোপর আজ গায়েহলুদ মুখে ক্ষীর দিয়ে এসো। তদ্রুপ অপর গ্রামেও বলা হয়, ও বুবুরা, ও ভাবিরা টোপ্পার আজ গায়েহলুদ মুখে ক্ষীর দিয়ে যাও। উঠানে নতুন বিছানা মেলিয়ে গায়েহলুদের পোশাক পরিয়ে বসিয়ে সামনে ক্ষীরের পসরা সাজিয়ে একে একে কয়েন আবার কেউ চামুচ দিয়ে ক্ষীর তুলে মুখে দেওয়ার দৃশ্য গ্রাম্য পরিবেশে ঐতিহ্যের বন্ধন। সীমাহীনভাবে ফুটে ওঠে গ্রামীণ বিয়ের বিচিত্রময় দৃশ্য। কেউ কেউ চামুচ দিয়েও মুখে ক্ষীর তুলে দেন। আর হাতে গুজে দেন কিছু টাকা। যা গায়েহলুদের ডালাতে রাখা হয়। বড় ভাবি ও দাদি-নানিরা আবার মজা করে ক্ষীর বর-কনের মুখে না দিয়ে নিজেরাই খেয়ে ফেলেন। হাসি-আনন্দ খুশির জোয়ারে মাঝরাত অবধি কেটে যায়। কেউ কেউ একে অপরের লাল নীল হলুদ রঙে রঙিন করে তোলে মুখমন্ডল, মাথার চুলগুলো; বিয়েবাড়ি চলে রঙের খেলা। পরদিন পাড়াপড়শির বাড়ি দলবেঁধে খাওয়ার ধুম চলে। এমন মায়াময় মমুময় গ্রামবাংলার বিয়েতে আনন্দের কমতি থাকে না। ঠিক বিয়ে-পূর্ব রাত্রে গরু-মহিষের গাড়িগুলোর ওপর ছই বিভিন্নভাবে সাজানো হয়। ছইয়ের ভেতরে ফুল-জরিসহ কিছু কিছু আয়না দিয়ে সাজানো হয়। চকচকে ঝকঝকে করে সাজিয়ে সব চেয়ে বড় গরু/ মহিষ গাড়িগুলো কনেপক্ষের বিয়েবাড়ি যাওয়ার জন্য আগাম বলা হয়। দিনের দিন অর্থাৎ বিয়ের দিন সময়মতো বরসহ বরযাত্রী নিয়ে হাজির হলো সারি সারি লাইন ধরে যাওয়া গরু-মহিষের গাড়ি। কনেবাড়ির গেটে সাজানো বিয়ের সজ্জিত গেটে চেয়ার-টেবিল, টেবিলে রাখা মিষ্টি, শরবত প্লেটে উপুড় করে গ্লাস সাজানো। ফিতে কেটে ভেতরে প্রবেশ করার সময় বরকে গাড়ি থেকে কোলে করে নিয়ে গেটের চেয়ারে বসানো হয়। কনেপক্ষের গেট খরচের হাসি আমোদের ঝামেলা আর্থিক লেনদেনে মিটিয়ে, একেকটি গ্লাস ট্রে থেকে রোমাল বিছিয়ে কৌশলে তুলে বরের মুখে দেওয়া যতক্ষণ না মিষ্টি-শরবতের গ্লাসটি না ওঠে। মিষ্টি খাওয়া শেষে বসার আসনে বরযাত্রীরা সবাই মিলে বসা। গ্রামীণ বিয়ের নাশতায় ক্ষীর মুড়িমুড়কি দই-মিষ্টি খাওয়া শুরুর আগমুহূর্তে বরের পক্ষে কনের জন্য নিয়ে আনা বাক্সভর্তি জিনিসগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয় কনেকে সাজ সাজরবে বিয়ে পড়ানোর জন্য উপযুক্ত তৈরি করতে। কাজিসহ মসজিদের ইমাম এসে হাজির হয়। নাশতা শেষে উকিল বানিয়ে কয়েকজন সঙ্গে নিয়ে কনের ঘরের দরজায় টোকা দেওয়া, দরকষাকষির মাধ্যমে বকশিশ মিটিয়ে উকিল মারফত দেনমোহর উল্লেখপূর্বক কনেকে কবুল বলানো আনন্দঘন মুহূর্ত, সত্যিই বৈচিত্র্যময়। টোপ্পার সঙ্গে টোপরের বিয়েতেও কোনো কিছুর কমতি নেই। ভরপুর খাওয়া-দাওয়া। সারা উঠোনজুড়ে খেজুরের পাতার তৈরি বিছানা বিছিয়ে সারি করে পদ্ম পাতায় বা কলাপাতায় খাওয়ার দৃশ্য। একমাত্র বরের বড় থালার পসরা সাজানো মাছের মাথা, ছাগলের মাথা এসব গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্যের বন্ধন। বরের হাত ধোয়ানো। কনের ছোট ভাইয়েরা এ কাজ করে থাকে। কুনুই পর্যন্ত সাবান মাখিয়ে বসে থাকা যতক্ষণ না বকশিশ পরিশোধ হয়। হাত ধোয়ানো শেষে হালকা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি। তারপর কনে প্রস্তুত হলে, বর কনেকে টেবিল সম্মুখে চেয়ারে বসানো হয়। বর-কনের শাড়ি এবং পাঞ্জাবি কষে বাঁধন দেওয়া হয়। জামাই মুখ দেখার এ সময় অন্য রকম অনুভূতি বিরাজ করে। কেউ মিষ্টি মুখ করিয়ে গলায় স্বর্ণের চেন পরায়, কেউ আংটি, কেউ ঘড়ি, টাকা-পয়সা দেয়। পিচ্চিরা কখনো বকশিশ নেওয়ার আশায় বরের টুপি নিয়ে পালায়। টোপ্পা ও টোপরের বিয়েতেও সাঁঝবেলায় অনেক গয়নাগাটিসহ শীতলপাটি দিয়ে বিয়ের বর কনেকে গরু-মহিষ গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। কনের সঙ্গে নানা-নানি অথবা দাদা-দাদির একজন পাঠানো হয়। সেই রীতি অনুযায়ী একজনকে পাঠাল। গরুর গাড়ি সারি করে মাইকে গান বাজতে বাজতে ফিরে আসে বরের বাড়ি। তেমনি রাত্রে ফিরল বিয়ের গাড়ি।

কদিন হলো টোপ্পাকে আনতে যাবে। নতুন মেয়েজামাই আনতে গেলে রেওয়াজ অনুযায়ী চিড়া-মুড়ি-খই লাগে। তাই ভেটোর হাটের ভানা কলে ভানতে গেল দলবেঁধে। সময়মতো চিড়া-মুড়ি-খই বাড়িতে আনা হলো গুড় দিয়ে মাখিয়ে বস্তায় ভরা হলো। ঝোপর গাঁয়ে টোপর বুবুর আনতে কে যাবে? সাজলো ছইয়ের গরুর গাড়ি/ছাড়লো টোজা বুবুর বাড়ি/ টোপ্পা বুবুর ছোট ভাই টোজা গরুর গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। দশ কিলো পথ যায়তে যায়তে/ আনন্দে গান গায়তে গায়তে/ মেঠোপথে ছুটলো গাড়ি, ঝোপর গাঁয়ে ঘেঁষে নদীর/পারে টোজা কেশে নদীর/ মাঝির খেয়ায় উঠলো গাড়ি। সবুজ ডানায় হরেক রঙে দুকূলে ফুল ফুটলো সারি, একূল ওকূল চাইতে চাইতে/ মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে/ পৌঁছে দিলো বুবুর বাড়ি; টোজা বাবুর গরুর গাড়ি। বুবুর সঙ্গে দেখা হলো/ হাসি-কান্না মাখা হলো। পেটপুরে খেয়ে-দেয়ে/ গরুর গাড়িই বুবুর নিয়ে/ সাঁঝবেলাতে ফিরল বাড়ি, টোজা বাবুর গরুর গাড়ি।।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close