মাহাথির মোবারক

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৯

শিয়ালের বাড়ি মুরগির নিমন্ত্রণ

হরিপুর গ্রামে পুরাতন একটি জঙ্গল ছিল। জঙ্গলটি ছিল অনেক বড় ও প্রাচীন। গ্রামের লোকেরা এই জঙ্গলটিকে তাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই দেখে আসছে। জঙ্গলটির সম্পর্কে তাদের তেমন কিছু ধারণা নেই, তবে শুধু এতটুকুই জানে জঙ্গলটি অনেক ভয়ানক ও হিগ্র প্রাণীদের আবাসস্থল। পুরো জঙ্গলজুড়ে ছিল শিয়ালের রাজত্ব। তাই গ্রামের লোকেরা জঙ্গলটির নাম রেখেছিল শিয়ালডোবা বলে। কারণ গ্রামের মানুষগুলো শিয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। দিনদুপুরে শিয়ালের আনাগোনা আর বিকাল হলেই শিয়ালের হুক্কাহুয়া...। আওয়াজ পুরো গ্রামকে আতঙ্কিত করে তুলত। তাই গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যা হলেই আর কেউ রাস্তাঘাটে বের হতো না। সন্ধ্যা হলেই শিয়ালের অত্যাচার শুরু হয়ে যেত পুরো গ্রামে। আর হরিপুর গ্রামের মানুষগুলো জলদি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকত। এই ভয়ানক জঙ্গলের পাশেই বাস করত এক গরিব কাঠুরিয়া। তার পরিবারের ছিল অনেক সমস্যা। ছিল অনেক অভব-অনাটনের মাঝে। এই গরিব কাঠুরিয়াটি তার জীবন চলার জন্য প্রতিদিন এই শিয়ালডোবা জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে তারপর চাল-ডাল কিনে। জঙ্গলটি অনেক প্রাচীন হওয়ায় তার অনেক ভয় হতো জঙ্গলে প্রবেশ করতে। আর কাঠুরিয়া মনে শখ করে একটি মুরগির পালত মুরগিটি ছিলে অনেক সুন্দর। আর তার সঙ্গে ছিল দুটি ছোট্ট বাচ্চা। বাচ্চাগুলো সারাক্ষণ তার পাশেই থাকত। কাঠুরিয়া তার গিন্নিকে সব সময় মানা করত মুরগি যেন কোনোভাবেই জঙ্গলে না যেতে পারে। কারণ কাঠুরিয়া যানত এই শিয়ালডোবা জঙ্গলেই একটি ধূর্ত শিয়াল আছে; সে যদি তার মুরগিকে একবার কোনোভাবে দেখতে পারে, তাহলে আর ছাড়বে না। কারণ ধূর্ত শিয়ালটি ছিল অনেক চালাক ও দুষ্ট। যত দুষ্ট বুদ্ধি ছিল সব তার মাথায়। তার দুষ্টুমির কারণে বনের অন্যান্য শিয়ালও রাগ হয়ে যেত। সারাক্ষণ তার নামে শিয়াল পন্ডিতের কাছে নালিশ দিত পশুরা। একবার এক নদীর ধারে একটা কোকিলপাখি মনের সুখে গান গাচ্ছিল; ঠিক তখনি ধূর্ত শিয়ালটি নদীর পারে গেল জল পান করার জন্য। যখন সে কোকিলের মিষ্টি সুরের গান শুনতে পেল; তখনি তার হিংসা জেগে উঠল এবং কোকিলকে বলতে লাগল। হে কোকিল ভাই, তোমার এত সুন্দর কণ্ঠ! এত ভালো করে কি করে তুমি গান গাও আমাকে শিখাবে? কোকিল তখন ধূর্ত শিয়ালের কাথায় কোনো কান না দিয়ে মনের সুখে গান গেয়েই যাচ্ছে আর গাছের নিচে বানর, টিয়াপাখি, বুলবুলি তার গান শুনছে। শিয়ালের কথায় কোকিল কান না দেওয়ার কারণে শিয়ালের রাগ আরো বেশি বেড়ে গেল, যার ফলে সে বলতে লাগল কোকিল ভাই নিচে নেমে নদী থেকে জল পান করে নাও। তারপর আবার গান ধরো, তাহলে আরো বেশি চমৎকার লাগবে। কোকিল শিয়ালের কথায় যখন নিচে নেমে পানি পান করতে লাগল, ঠিক তখনি ধূর্ত শিয়াল তার ঘাড় চেপে ধরল পানির নিচে এবং এভাবেই কোকিলের মৃত্যু হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে বানর টিয়া আর বুলবুলি জলদি শিয়াল পন্ডিতের কাছে নালিশ দিল। তখন ধূর্ত শিয়ালকে ডেকে নেওয়া হলো এবং তার কাছে থেকে ঘটনা সত্যতা যাচাই করে বনের সব পশুরা তাকে শিয়ালডোবা বন থেকে বের করে দিল। তখন এই দুষ্ট ধূর্ত শিয়ালটি নদীর পাড়ে গিয়ে বসবাস করতে লাগল।

তখন থেকে সে একা হয়ে গেল। বনের কোনো পশুই তার সঙ্গে কথা বলে না। কাছে আসে না। তার জন্য শিয়ালডোবা জঙ্গলে প্রবেশও নিষেধ করে দিয়েছি শিয়াল পন্ডিত। তাই সারাক্ষণ শুধু ধূর্ত শিয়ালটি মন খারাপ করে নদীর পাড়ে বসে থাকে আর কান্না করে। সব পশুই বিকাল বেলায় নদীতে জল খেতে এসে তাকে দেখতে পায়, কিন্তু কেউ তাকে কাছে ডাকে না। এদিকে ধূর্ত শিয়ালটির মাথায় এক দিন একটা দুষ্ট বুদ্ধি এলো। সে এক দিন বনজঙ্গল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঠুরিয়ার বাড়িতে চলে গেল। গিয়ে দেখে কাঠুরিয়ার মুরগিটি বসে বসে কান্না করতেছে। শিয়াল জিজ্ঞেস করল, কি গো ভাই! কি হয়েছে তোমার? মনের দুঃখে কান্না করতেছো? এত কিসের দুঃখ তোমার। নিশ্চয় তোমার মালিক তোমাকে ভালো কিছু খেতে দেয় না, তাই হয়তো বসে বসে কান্না করতেছো? তুমি আগামীকাল আমার বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসো। আগামীকাল আমার বাড়ি তোমার নিমন্ত্রণ রইল। মুরগী বলল, না ভাই খাওয়ার জন্য নয়। আমার আদরের বাচ্চা দুটা কে হারিয়ে ফেলেছি। আজ দুদিন ধরে তাদের খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয় তাদের কোনো শিয়ালে নিয়েছে গেছে। তাই কাঁদতেছি।

ধূর্ত শিয়াল তখন বলল, কী, এত বড় সাহস কার! কে তোমার বাচ্চা নিয়েছে? আচ্ছা তুমি আগামীকাল আমার বাড়ি এসো, তাহলে আমিই তোমার বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বের করে দেব এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তিও দেব। আর তোমার জন্য একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন সকালবেলা খুব ভোরে মুরগি শিয়ালের সঙ্গে তার বাড়ি রওনা হলো নিমন্ত্রণ খাওয়ার জন্য। নদীর এক পাশ দিয়ে শিয়াল আর মুরগি দুজন যাচ্ছে। ধূর্ত শিয়াল তাকে অনেকদূরে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে মুরগির ক্লান্তি এসে গেছে। শিয়ালকে জিজ্ঞেস করল মামু আর কতদূর তোমার বাড়ি? ধূর্ত শিয়াল বলল, এই তো! এসেই পড়েছি। এ কথা বলে আরো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে অনেকদূরে ওই নদীটির কাছে নিয়ে গেল। মুগরিটি মনে মনে কিছুটা ভয় পাচ্ছে, কিন্তু কী আর করার এখন নিমন্ত্রণ খেতে শিয়ালের সঙ্গে এসেই পড়েছে। ধূর্ত শিয়াল তাকে তার গুলপাতার জুপে নিয়ে গেল আর বলল, তুমি বস আমি তোমার জন্য চমৎকার একটি খাবার নিয়ে আসছি। মুরগি তো ভেজায় খুশি আজ অনেকদিন পর ভালো কিছু খাবার জুটবে কপালে। শিয়াল যখন গুলপাতায় করে কিছু একটা তার সামনে এনে দিল মুরগিটি তখন বলল, কী মামা এত সুন্দর করে ডেকে নিয়ে এসেছো আমার জন্য? নিশ্চয়ই অনেক উন্নত মানের কে নো খাবার হবে? মুরগির জিবে জল এসে গেল এবং যখন সে গুলপাতা খুলল; তখনি চমকে উঠল! এইটা কী দেখলাম! এ তো দেখি আমার বাচ্চা দুটো। মুরগি ডাগর ডাগর চোখে ধূর্ত শিয়ালকে জিজ্ঞেস করল, কিরে বিশ্বাসঘাতক! আমার বাচ্চাগুলো এখানে কেমনে এলো আর তাদের মারলইবা কে? ধূর্ত শিয়াল তখন বলল, এই তো আরেকটু পর সব কিছুই জানতে পারবে।

এখন শুধু শুধু মাথা গরম করে কোনো লাভ নেই। এ কথা বলেই ধূর্ত শিয়াল মুরগির দিকে থাবা দিল। কিন্তু মুরগি জলদি করে উড়ে গিয়ে তার মাথার ওপরে একটি জারুলগাছের ডালে গিয়ে বসল।

কিরে বেটা ভয় পেলে নাকি? ওপরে উঠলে কেন, নিচে নেমে আয়। নিমন্ত্রণ খাবে না? আমি এত সুন্দর করে তোমার জন্য সব কিছুই ঠিক করলাম আর তুমি এখন রাগ করে গাছের ডালে বসে আছ। জলদি নেমে আস আমি এত ভালোবেসে তোমার বাড়ি থেকে তোমাকে নিয়ে এলাম এখন যদি তুমি খালি মুখে ফিরে যাও, তাহলে আমার মানবতা আর রইল কোথায়? জলদি নেমে এসো। এই বলেই ধূর্ত শিয়াল মুরগিটিকে খাওয়ার জন্য গাছে উঠতে লাগল। শিয়ালের গাছে ওঠা থেকে মুরগি নিজের জীবনের আাশা ছেড়ে দিল এবং বলতে লাগল শিয়াল! তুই আমার বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেললে এখন আমাকেও মেরে ফেলবে? শিয়াল কোনো কথা না বলে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। মুরগি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঠুরিয়াকে ডাকতে লাগল। শিয়াল বলছে, ভাগ্নে এই নদীর পাড়ে এত সকালে তোমার কাঠুরিয়া কী করে আসবে শুনি? মুরগিটি তখন নিজের জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ মুরগির নজর পড়ল জারুলগাছের একটা ডালে। ডালটি ভরা ছিল একটি মৌমাছির বাসা দিয়ে। মুরগি তখন বুদ্ধি করে সেই গাছের ডালায় জোরে একটা নাড়া দিয়েই গাছের নিচে নেমে পড়ল। মৌমাছির বাসা যখন ভেঙে গেল, তখন তো মৌমাছিগুলো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল আর তখনি তারা গাছের ওপরে ধূর্ত শিয়ালটিকে দেখতে পেল। আর তারা মনে করল এই শিয়ালই তাদের বাসা ভেঙে দিয়েছে। এই ভেবে সব মৌমাছি শিয়ালের পিছু ধরল। মৌমাছির কামড়ে শিয়াল হুক্কাহুয়া আওয়াজ করে করে নদীতে লাফিয়ে পড়ল আর এভাবেই তখন ধূর্ত শিয়ালটির মৃত্যু হলো। আর ধূর্ত শিয়ালের মৃত্যু দেখে মুরগিটি আনন্দে তাকদিনাদিন দিন গান ধরে আবার বাড়িতে ফিরে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close