শরীফ সাথী

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৯

গোপন কথা

বিকালে তীরধরা দ্বীপের মায়াবী পরিবেশে দাদু ও নাতির মজাদার আড্ডার মাঝে হঠাৎ নাতি বলল, দাদু তুমি আজ বহু পুরোনো রূপকথার গল্প শোনাও না? বাস্তবতার দিন-কাল ঠেলে। নাতি ভাই, তাহলে আমি আমার দাদুর কাছে যে গল্প শুনেছিলাম দর্শনা কেরুর ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে; সেই গল্পটিই আজ তোকে বলে শোনায়।

দিন আনা দিন খাওয়া যার সংসার, ব্যথায় যার কুঠার বসায় বুকে তার নাম ব্যথু হলে দোষ কী? হাবাগোবা ভ্যানচালক কার্পাসডাঙ্গা বাজারের। পাঁচ বছরের ঘর-সংসারে আজও প্রদ্বীপ জ্বালাতে পারিনি। বউটার সুরোত ভালো। তাইতো বাপু পড়শির মনটা আলো।

সকালে ঘুম থেকে ওঠা মাত্র বাড়িয়ালা (বউ) ঝোলা ধরে দিল ব্যথুর হাতে, সঙ্গে দিল পাঁচ টাকা। এই শোন, (কর্কশ কণ্ঠে বলে) পাঁচ টাকার কিছু খেয়ে নেবে? আর বাড়ি আসার সময় অবশ্যই দুই কেজি চাল আর সঙ্গে বাজার থাকে যেন? কুল আটি ভরা পায়ে ভ্যানচালকের কষ্ট হয় বৈকী। কী আর করা বউ তাড়া দেয়। কার্পাসডাঙ্গা বাজারে এসে ব্যথু ভাবছে, থাক এ টাকা আর খাব না, যদি ভাড়া না হয়। ভাবতে ভাবতে এক ফটকা বাজের আবির্ভাব ঘটল। বলে, এই চুয়াডাঙ্গা যাবে? ব্যথু বলল, যাব মিয়া সাব, ভাড়া কিন্তু ৩০ টাকা দেওয়া লাগবে। পকেট যার ফাঁকা, তার কি আর হয় চোখ বাঁকা। ভ্যানে চেপে বসে চলল দুজন।

পথিমধ্যে ব্যথুর প্রশ্নÑ মিয়া সাব কী করেন?

-সোজাসাপ্টা উত্তরÑ কথা বেঁচে খাই।

-সে আবার কেমন কথা?

-তুমি যদি জানতে চাও প্রতি কথার দাম ১০ টাকা লাগবে। শুনবে তুমি?

ব্যথু মনে মনে ভাবল ৩০ টাকার মধ্যে ১০ টাকা যায় যাক। শুনিই না একটি কথা। ফটকাবাজের প্রথম কথা

-ফেলিসতো দেখে শুনে ফেলিস।

কথাটা শুনে ব্যথু মুখস্থ করতে করতে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে গেল। লোকটি তো খুবই চিন্তিত। বাকি ১০ টাকা কীভাবে দেবে। পকেট তো পুরো ফাঁকা। ব্যথু আবার বলল, মিয়া সাব ভাড়া আর দিতে হবে না। আর একটি কথা শুনাওনা। লোকটি হাসতে হাসতে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে মিশে গোপন কথা বলিও না। লোকটি চলে যাওয়া মাত্র ব্যথুর মাথায় চিন্তার ভার বেড়ে গেল। কীভাবে যে আজকের বাজার হবে। বউ তো আচ্ছা বকুনি দেবে। কথা শুনে তো এ ভাড়া মারা ৩০ টাকাও গেল। যাহোক মনের দুঃখে পাঁচ টাকা খেয়ে বড় বাজার ঘুরেফিরে আসছে। ভ্যান ঘুরিয়ে চুয়াডাঙ্গার কোর্টের কাছে আসামাত্রই কিছু লোক থামিয়ে তাকে বলল,

-এই এখানে এক বুড়ি মারা গেছে। ২০০ টাকা সবার কাছ থেকে তোলা হয়েছে তোমাকে দিচ্ছি; যেখানে-সেখানে ভাগাড়ে ফেলে চলে যেও? কথামতো ভাবল, দুশো টাকা যদি হয়। এখানে কেউ তো আর আমার চেনেনা, বুড়ির তুলে নিয়েই যায়। বহু পুরোনো লেপবালিশসহ জড়িয়ে তুলে দিল সবাই মিলে। পথিমধ্যে নদীর তীরে এসে ভ্যান ভিড়িয়ে বুড়িকে লেপসহ টেনে ফেলে দিল। বুড়ি তো গড়াতে গড়াতে নদীতে গেল। এদিকে ভ্যানের চাকার নাটে গেল বালিশের কোনা ছিঁড়ে আটকে। টানাহেঁচড়া করতেই কিছু পয়সা গড়িয়ে পড়ল।

ব্যথুর মনে হলো, সেই কথাÑ ফেলিস তো দেখেশুনে ফেলিস। ব্যথু বালিশ নাড়াতেই টাকা-পয়সার আলামত বুঝে বালিশটা ভ্যানে রাখল। পড়ে যাওয়া পয়সাগুলো রাখল পকেটে। বুড়ির সারা জীবনের জমানো অর্থ বোঝাই বালিশ এখন ব্যথুর দখলে। ময়লাযুক্ত বালিশ ভ্যানে কেউ সন্দেহ করবে না, এতে কী আছে। বাড়ি পৌঁছে ঘরের কোণের মাটি দিয়ে তৈরি কোলার ভেতর রাখল সব টাকা-পয়সা।

ব্যথু এখন প্রতিদিন বউয়ের কথামতো ভালো ভালো বাজার করে। কিন্তু ভ্যানচালক আর ভ্যান ঠেলে না। রূপসী বউয়ের কথায় এনেছে এবার শ্যাম্পু, সুগন্ধি বাসনা তেল আরো অনেক পারফিউম। বউ নদীতে যায় তেল-শ্যাম্পু নিয়ে। হঠাৎ এত সব পরিবর্তন দেখে ছিঁচকে চোরের বউ ভ্যানচালক ব্যথুর বউকে বলল,

-হ্যারে তোদের তো খুব অভাব ছিল, এসব কীভাবে হলো? ব্যথুর বউ বলল, আমার স্বামী আর ভ্যান চালায় না। তবে যা বলি তাই কিনে আনে?

-তোর কথা সব শোনে বুঝি?

-হ্যাঁ ।

জবাব শোনা মাত্র চোরের বউটা বলল, তোর গলাটা বড্ড ফাঁকা লাগে, সোনার হার নিতে পারিসনে? রাতে ব্যথুর কাছে আবদার করে বলল, আমার সোনার হার কিনে দিবা কালকে? যেমন কথা তেমন কাজ। পরদিন ঘাটে ব্যথুর বউয়ের গলায় পাঁচ ভরি ওজনের হার দেখে, চোখ উল্টিয়ে কপালে গেল ছিঁচকে চোরের বউটার। পরদিন আবার বলল, তোর কান দুটি বড্ড ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে, সোনার দুল হলে ভালো হয়। তার পরদিন আবার দুল কানে ঘাটে স্নান সারতে গেছে। চোরের বউটা আবার বলল, হাত দুটি একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সোনার চুড়ি হলে তোর এই সুন্দর হাতে ভালোই মানায়। কথামতো পরদিনই সোনার চুড়ি হাজির। এত সব পরিবর্তন দেখে চোরের বউটা বলল, তোর স্বামী এত টাকা পায় কোথায়? তুই জিজ্ঞাসা করেছিস কোনো দিন? তুই তো ব্যথুর ঝলমলে-টলমলে লক্ষ্মী বউ। জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিসনে? এমন মিষ্টি করে বলা কথা শুনে ব্যথুর বউ বেজায় খুশি হয়ে রাত্রে ব্যথুকে আদর করতে করতে ঘটনা শুনতে চাইলে ব্যথু সরল-সোজা মনে সব খুলে বলল। মাটির ওই কোলার ভেতর টাকা-পয়সা ভর্তি, সব সাজানে-গোছানো।

পরদিন বাসনা তেল মাথায় দিতে দিতে চোরের বউ সব ঘটনা শুনে নিল। পরের রাত্রে যা হওয়ার তাই হলো। কোলা বরাবর বড় সিঁদ কেটে কোলাসহ সবকিছু চোর চুরি করে নিয়ে চলে গেল। ব্যথু ঘুম থেকে উঠে বউয়ের কথামতো বাজারের ব্যাগ নিয়ে, পয়সা নিতে গিয়ে দেখতে পেল মাটির কোলাটি নেই। দেয়ালে সিঁদ কাটা। হায়! হায়! করে ব্যথু কেঁদে উঠল। বউটাও হাজির। দুজনেই কাঁদতে লাগল। ব্যথু গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল সেই কথা। গোপন কথা কাউকে বলিসনে। ব্যথু ঘরের বাতা থেকে নেকড়া টেনে ভ্যান মুছে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল চিন্তার কাছে জীবন সঁপেÑ। সত্যিই দাদু ভাই, গোপন কথা বউকে না জানালে এমন ফল হতো না। হ্যাঁ নাতি ভাই? আজ ওঠা যাক? তোর মা আবার তোকে খোঁজাখুঁজি করবে? চলো দাদু ভাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close