মোস্তাফিজুল হক

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

যুবরাজ ও মুনিয়া পাখি

একসময় এক রাজার তিন ছেলে ছিল। তিন যুবরাজের নাম ছিল যথাক্রমে জামাল, জারিফ ও জাবির। তিন ভাইয়ের মধ্যে যুবরাজ জাবির নীতিবান ও দয়ালু বলে মহারাজ তাকে খুব বেশি স্নেহ করতেন। এক দিন রাজা স্বপ্নে দেখলেন, তার বড় ছেলেরা জাবিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এতে তিনি খুবই ভয় পেলেন এবং ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজ্যের সব হেকিম তার রোগ নিরাময় করতে অক্ষম হলেন। মহারাজ জামশেদ ছিলেন তার সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিচক্ষণ শাসক। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় অল্প দিনেই তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হলো। রাজার অসুস্থতায় রাজ্যের মানুষের মনেও শান্তি নেই। এতে মহারানি মারিয়াও ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

অবশেষে অশীতিপর এক গণক রাজাকে পরামর্শ দেন যে, পৃথিবীতে একমাত্র মায়াবী মুনিয়া পাখির গান শুনেই তার হারিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য ও প্রশান্তি ফিরে আসবে। আর এই পাখিটাকে রাজ্যের উত্তরে গহিন বনেই পাওয়া যাবে। এই পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে মহারানি তার জ্যেষ্ঠপুত্র ও অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা যুবরাজ জামালকে মায়াবী মুনিয়ার সন্ধানে পাঠালেন। বীর যুবরাজ ঘন বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু ঘোরাঘুরি করে ক্লান্তি ও তৃষ্ণা নিয়ে শেষ বিকালে একটা জামগাছের নিচে এসে বসলেন। কেউ জানে না যে, এই গাছেই সেই মায়াবী মুনিয়া পাখি রাত কাটায়। যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল; তখন সেই পাখিটা তার সাতটা গানের প্রথমটার সুর বাতাসে ছড়িয়ে দিল। সেই গানের সুর এতই মিষ্টি মধুর ছিল যে, যুবরাজ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এভাবে গভীর রাতে পাখিটা সপ্তম সুরের গান শেষ করলে যুবরাজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তখন পাখিটা ঘুমন্ত যুবরাজের ওপর মলত্যাগ করল, আর সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজ পাথরে পরিণত হয়ে গেল।

যুবরাজ জামাল যখন এক বছর হয়ে গেলেও ফিরে এলেন না, তখন অধৈর্য হয়ে রানি মা তার দ্বিতীয় পুত্র জারিফকেও সেই পাখি ও তার ভাইয়ের খোঁজে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যুবরাজ জারিফও ঠিক একই গাছের কাছে এসে পৌঁছলেন! ফলে তাকেও সেই মায়াবী মুনিয়ার সুরের মায়াজালে রাতের গভীরে ঘুমন্ত অবস্থায় পাথরে পরিণত হতে হলো!

অবশেষে সেই পাখি ও ভাইদের খোঁজে সবচেয়ে প্রিয়পুত্র যুবরাজ জাবিরকেও পাঠানো হলো। জাবির সৌভাগ্যবান ছিল বলেই হয়তো যাত্রাপথে গুণবতী ও বুদ্ধিমতী এক তরুণীর সাক্ষাৎ পেল।

থামুন, মহামান্য যুবরাজ। সেই বনের পাশেই এক কাঠুরিয়া বাস করত। সেই কাঠুরিয়ার একমাত্র মেয়ের নাম ইরিনা। তরুণী ইরিনা রাজকন্যার চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দরী নয়। হঠাৎ সেই তরুণী যুবরাজকে পেছন থেকে ডাক দিলেন। যুবরাজকে থামিয়ে তরুণী বললেন, মায়াবী মুনিয়া একটা ঘাতক ও ভয়ংকর পাখি! তাই সে ধূর্ত পাখির মায়া থেকে রক্ষা পেতে আপনাকে কিছু পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে সাহায্য করতে চাই। তরুণী প্রথমে তাকে একটা ছুরি ও লেবু দিল। এরপর সে বলল, যদি নিজেকে অবর্ণনীয় দুরবস্থা থেকে মুক্ত রাখতে চান, তবে মায়াবী মুনিয়ার সপ্তসুরে মোহাচ্ছন্ন হওয়া যাবে না। পাখিটা যখনই গাইতে থাকবে, তখনই আপনার বাম হাতে ক্ষত তৈরি করে তাতে লেবুর রস লাগাবেন। এতে করে ব্যথা ও জ্বালার চোটে ঘুম আসবে না। সাতটা গান গাওয়া শেষ হলে পাখিটা মলত্যাগ করবে। সে মল যেন কোনোমতেই আপনার গায়ে না পড়ে। যদি গায়ে পড়ে তবে আপনিও আপনার বড় ভাইদের মতো পাথরে পরিণত হয়ে যাবেন। আর পাখিটা সপ্তম গান শেষে মলত্যাগ করে ঘুমিয়ে পড়বে। এই সুযোগে ওটাকে বন্দি করে ফেলতে হবে। পাখিটা ধরা পড়লে বেঁধে রাখার জন্য এক টুকরো সোনার সুতা আর ভাইদের প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য দুই শিশি মন্ত্রপড়া পানি দিলাম। সৃষ্টিকর্তা আপনার সহায় হোন।

মায়াবী মুনিয়াকে বন্দি করে ভাইদের মুক্ত করলেন যুবরাজ জাবির। বড় দুই ভাই তার এমন কৃতিত্বে ঈর্ষান্বিত হলো। তারা ভাবল জাবিরকে মেরে পাখিটাকে নিয়ে দরবারে পৌঁছালে তারাই কৃতিত্বের ভাগিদার হবে। যাহোক, দুই ভাই তাকে ছেড়ে দেওয়া অথবা কিছু একটা করার জন্য নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিল। জামাল ছোট ভাইয়ের শিরñেদ করতে ইচ্ছুক। কিছুটা কম নিষ্ঠুর জারিফ বলল, মারধর করে ফেলে রেখে গেলেই যথেষ্ট। বনের পশুরা খেয়ে ফেলবে। আপদ শেষ হবে।

জাবিরকে মেরে বড় দুই ভাই পাখিটাকে তাদের জিম্মায় নিল। তাকে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে রেখে দুই ভাই রাজপ্রাসাদের পথে রওনা দিল। যুবরাজ জামাল ও জারিফ রাজদরবারে পৌঁছে মহারাজকে বলল যে, পাখিটাকে তারাই ধরেছে। কিন্তু পাখিটা সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুধু জাবির জাবির করছে। মোটেও গান গাইছে না! ফলে রাজা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

যুবরাজ জাবির সত্যিই ভাগ্যবান। ইরিনা তাকে রাস্তায় অসহায় অবস্থায় পেয়ে সেবাযতœ করে সুস্থ করে তুলল। সুস্থ হয়ে রাজকুমার নিরাপদে রাজদরবারে ফিরে এলেন। তার ফিরে আসার সুসংবাদে পাখিটি খুশি হয়ে আপনমনে মধুর সুরে গান গাইতে লাগল। মহারাজ দুই দিনেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি সুস্থ হয়ে জাবির ও ইরিনার কাছে জামাল ও জারিফের ঘটনা জেনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তার চোখেমুখে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। তিনি তার দুই বড় ছেলের মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলেন। কিন্তু কনিষ্ঠ যুবরাজ জাবির অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বাবার কাছে ভাইদের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। মহারাজ তার প্রিয় ছেলের দাবিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। এবার জামাল ও জারিফ তাদের ভুল বুঝতে পেরে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করল। ফলে রাজ্যে আবার শান্তি ও আনন্দ ফিরে এলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close