ফারুক হোসেন সজীব

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভূতে মারল ঢিল

আজ বাড়িটা একদম ফাঁকা। সুনশান নিরিবিলি। এত নিরিবিলি হওয়ার কারণও আছে। টানা দুদিন বিয়েশাদির তুমুল হট্টগোল হয়ে গেছে বাড়িতে। শত শত মানুষের সমাগম ছিল। খাওয়া দাওয়া-নাওয়া আরো কত কী যে ধকল গেছে বাড়িটার ওপর দিয়ে, তা আর কী বলব! কিন্তু এখন? বাড়িটা একদম ফাঁকা যেন শ্মশান! আসলে গতকাল রিয়ানের বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আজ আবার সবাই গিয়েছে বোনটাকে আনতে। কখন ফিরবে কে জানে? ফিরতে ফিরতে হয়ত গভীর রাত হয়ে যাবে। অনেক দূরে শহরে বিয়ে হয়েছে বোনের। এজন্যই বাড়িটাই ফাঁকা। কারো কোনো সারা শব্দও নেই। বাড়িতে রিয়ান আর মা ছাড়া কেউ নেই। তবে বাড়িটার কথা বলতে গেলে বলতে হয়। রিয়ানের দাদা একটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে এই বাড়িটি অনেক সস্তা দামে কিনেছিলেন। বাড়ির পূর্বদিকে নাকি একটি কালীঘরও ছিল তখন। আর বাড়ির নিচে যে হিজল গাছটি আছে? ওখানে ছিল একটি শ্মশান ঘাট। আগে এপাড়ায় হিন্দুদের মরা পোড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ছিল না। তাই যেখানে ফাঁকা জায়গা পেতেন, সেখানেই মরা পোড়াতেন। বাড়িতে আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো! অমাবস্যার গভীর রাতে বাঁশঝাড় থেকে দারুণ মিষ্টি মধুর সুবাস বের হয়। কিসের সুবাস? রিয়ানের মা বলেন, আগে ওই বাঁশঝাড়ে কাছে হিন্দুরা মনসার পূজা করত। সাপের পূজা করতে দুধ কলা আর কত কী পাকা ফল লাগে কে জানে? তার মানে রাতে যখনই এই সুবাস ছড়াবে বুঝতে হবে, বাঁশঝাড় থেকে সাপ বের হয়েছে। আসলে তো সাপের গা দিয়েই অমন গন্ধটা বের হয়। মায়ের কথা শুনে রিয়ানের ভীষণ ভয় লাগে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আসলে কিলবিল করা সাপ দেখে তো সবারই ভয় লাগে তাই না?

কিন্তু কোনো উপায় নেই! এই বাড়িতেই ওদের থাকতে হয়। তাই রাতে সাপের ভয়ে রিয়ান মশারি টানিয়ে ঘুমায়। কিন্তু বিয়ের লোকজনের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

রিয়ান বোনকে খুব মিস করছে। মনে হচ্ছে কত দিন বোনটাকে সে দেখে না। রিয়ানের মাও ওঘর থেকে রিয়ানকে বললেন, ওদের ফোন করে একটু কোনোতো বাবা, ওদের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? পথে আবার কোনো সমস্যা হলো কি না? খুব চিন্তা হচ্ছে। রিয়ানের মা হাতে তসবি জপছে।

রিয়ান ওর চাচাত ভাইকে ফোন দিল। চাচাত ভাই জানাল, এখনো ঘণ্টা দুয়েক সময় তো লাগবেই, কারণ রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। আসলে বোনটার শহরে বিয়ে হলো কি না তাই। শহরের প্রতিটি রাস্তায় তো জ্যাম থাকেই। রিয়ান অবশ্য ভেবেছিল সেও বোনকে আনতে যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই?

এদিকটা সামলানোর যে আর কেউ নেই। তাছাড়া বাড়ি ঘর পরিষ্কার করা। চেয়ার টেবিল শোবার ঘরটি ঝকঝকে তকতকে করে তোলা চারটেখানি কথা নয়! রিয়ানের আবার পোষা কিছু কবুতরও আছে। ওদের ঠিকমতো খেতে না দিলে অন্যের বাড়িতে ফুড়–ত দেয়। কবুতরগুলো যে বাড়িতে বেশি আদর খাওয়া পায়। সেবাড়িতেই চুপটি, ঘাপটি মেরে থাকে। তবে ওরা কোলাহলপূর্ণ বাড়ি একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ বাড়িটা সত্যি অনেক বেশিই কোলাহলমুক্ত। এতো কোলাহলমুক্ত যেন আগে কোনোদিনই ছিল না। হঠাৎ আজ বাড়িটা কেমন অদ্ভুত, স্তব্ধ আর শান্ত গুমোট বেঁধে আছে। কী যেন হয়েছে বাড়িটার! চারদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকারও মনে হচ্ছে।

রিয়ান সারা দিন কাজ করে এখন বেশ ক্লান্ত। তাই শরীরটা একটু এলিয়ে দিল বিছানায়। চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। কিন্তু কে যেন অবচেতন মনে রিয়ানকে জানান দিচ্ছে ঘুমালে চলবে না। আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকতে হবে। একটু পরেই আত্মীয়স্বজনরা চলে আসবে। কিন্তু ঘুমে রিয়ানের চোখ ঢুলুঢুলু। চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে তার। রিয়ান পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। এখন রিয়ান সটান হয়ে ঘুমের গভীরে বিচরণ করছে। আচমকা দুরুম করে একটা শব্দ হলো! কিসের শব্দ? রিয়ার পরি-ধরি-মরি করে উঠে বসল। এদিক ওদিকে তাকাল। রিয়ানের চোখ দুটি বড় বড় হয়ে আছে! কী হলো? কীসের শব্দ হলো?

আবারও টিনের চালায় শব্দ হলো। যেন খট-খট-খটাস শব্দ! তারপর ঝুরঝুর করে বাঁশপাতা থাকে ঝরে পড়তে লাগল কীসের যেন গুঁড়ো! মনে হচ্ছে মাটির গুঁড়ো! রিয়ান ভয়ে মা-মা বলে ডাকল। কিন্তু একি মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন? আসলে মা বোনের চিন্তায় অস্থির হয়ে হয়ত তসবি জপতে জপতেই অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছেন। রিয়ান তবু মাকে ডাকছে। কিন্তু একি! রিয়ানের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হচ্ছে না। গলা দিয়ে বরং ফ্যাসফ্যাস শব্দ হচ্ছে! কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না! মনে সাহস আনতে হবে। বুকে বল আনতে হবে। রিয়ান খটাস করে দরজা খুলল। দরজা খুলেই রিয়ান স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। যেন সে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। নিজের চোখকে সে কিছুতেই বিশ^াস করতে পারছে না। ওটা কী মানুষ? নাকি অন্য কিছু? সাদা কাপড় পরে ইয়া বড় লম্বা পাহীন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনেই? রিয়ানকে দেখে আবার মাথাও দোলাচ্ছে! রিয়ান যেন টাল খেয়ে পরে যাবে মাটিতে। কিন্তু সে শক্ত করে বারান্দার খুঁটিটা ধরল। রিয়ানের যেন হিতাহিত জ্ঞান নেই। রিয়ান এক দৃষ্টিতে সাদা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা কী মানুষ? নাকি অন্য কিছু? ভূত নয়তো? ভূতের নাকি পা থাকে না? ওরে মারে বলে রিয়ান অস্ফুটস্বরে মাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ রিয়ানের মায়ের কাছে যেন কিছুতেই পৌঁছাচ্ছে না। রিয়ান শুধু ভূত! ভূত বলে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ করছে। রিয়ান খেয়াল করল, ভূতটা তার লম্বা হাত দিয়ে রিয়ানের দিকে লক্ষ করে মারল এক ঢিল। কিন্তু ঢিলটি রিয়ানের গায়ে না লেগে লাগল ঠিক টিনের চালার ওপরে। তারপর টিনের চালা থেকে ঝুরঝুর করে মাটির গুঁড়ো বারান্দায় চালায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল। একটি ঢিল আবার রিয়ানের সামনেও এসে পড়ল। রিয়ান দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ছোট ছোট মাটির ঢিলাগুলো দেখতে পাচ্ছে। রিয়ানের এখন সত্যি সত্যিই মাথা ঘুরাচ্ছে যেন টাল খেয়ে পড়ে যাবে। হঠাৎ বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠল। রিয়ান দেখল একটি মাইক্রোবাস রাস্তা থেকে তাদের উঠোনের ওপরেই চলে এলো। মা ওঘর থেকে চেঁচিয়ে বলছে, ওরে রিয়ান! তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠ। তোর বোন বর সবাই চলে এসেছে। রিয়ান বারান্দায় দাঁড়িয়েই ছিল। কিন্তু একি! মা তো রিয়ানকে দেখতেই পেলেন না। রিয়ান মায়ের ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কী আশ্চর্য ! তাহলে বারান্দায় এতক্ষণ কে দাঁড়িয়েছিল? ওটা কী রিয়ান ছিল না? তাহলে ওটা কী স্বপ্ন ছিল? রিয়ান স্বপ্ন দেখছিল? কিন্তু স্বপ্ন এতো বাস্তব হয় কি করে? রিয়ানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না! রিয়ান দেখতে পেল সত্যি সত্যি বারান্দায় একটি শুকনো মাটির ঢিলা পরে রযেছে! রিয়ান একবার ঢিলার দিকে আর একবার মাইক্রোবাসের আলোর দিকে তাকাচ্ছে? রিয়ান হতভম্ভ হয়ে বারান্দার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে মাইক্রোবাস থেকে রিয়ানের বোন বর এক সঙ্গেই তার দিকেই হেঁটে আসছে। দুজনের মুখ হাসিখুশি। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় বোনটাকে কী সুন্দর আর রূপবতীই না লাগছে! রিয়ান বোনটাকে দেখে হেসে ফেলল। হঠাৎ রিয়ানের কী যে হলো! সামনে পড়ে থাকা মাটির ঢিলার কথা সে বেমালুম ভুলে গেল। এখন সে বোনকে জড়িয়ে ধরে ছোট্টটির মতো অবুজের

কান্না কাঁদছে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close