সাদিক আল আমিন

  ২৭ জুলাই, ২০১৯

মোতালেব স্যারের বদলি

ব্যাপারটা সবার কাছে হাস্যকর মনে হলেও রোকনের কাছে সেটা কোনোমতেই হাস্যকর নয়। বরং অতিরিক্ত লজ্জাজনক। লজ্জায় নিজের লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা মুখটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে তার। এইমাত্র প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে সে। আনিস স্যারকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি রোকনকে বাথরুমে যেতে দেননি। আর নিম্নচাপের অবস্থাটাও ছিল ভয়াবহ। সহ্য করতে না পেরে রোকন প্যান্টেই কাজটা সেরে ফেলে। আর এ ঘটনা দেখে ক্লাসের পরিবেশ তুঙ্গে উঠেছে। ক্লাসের দর্জাল ছেলেগুলো তাকে দেখে হো হো করে হাসছে। কুটনি মেয়েরা তাকে নিয়ে কূটনৈতিক বৈঠকে বসেছে। রোকন কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সবার উদ্দেশে একটা ভেংচি কাটল। সেটা দেখে সবাই আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

ক্লাস ওয়ানের ক্লাসটিচার মোতালেব হোসেন খুব বদমেজাজি লোক। স্কুলের বজ্জাত ছেলেপেলেদের দেখলে তার গায়ের লোম জ্বলে ওঠে। আর সেজন্যই শকুনের দৃষ্টিতে সবাইকে দেখেন এই আশায় যে, কেউ যখনি কিছু একটা দোষ করে বসবে, তিনি তার তিন হাত লম্বা মোটা বেতের লাটিটা তার পিঠে চালান করবেন। রোকন সবার হাসাহাসিতে অতিষ্ঠ হয়ে যখনই ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, তখনই রোকন মোতালেব স্যারের চোখে পড়ে গেল। আনিস স্যারের পরে এখন তার ক্লাস আর তিনি রোকনের বের হওয়ার সময়েই ক্লাসের দরজায় উপস্থিত। ব্যাপারটা কী রকম গুরুতর, তা সবাই ইতোমধ্যে এক রকম আন্দাজ করে নিয়েছে। আজ তবে রোকনের কাজ সেরেছে! ক্লাসের সবাই ব্যাপারটা দেখে নিজ নিজ জায়গামতো আদর্শবান ছাত্রের মতো বসে পড়ল; যেন কেউ কিছু জানেইনা! মোতালেব স্যার রোকনকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন; কিন্তু সবাই তার কাছে যে ব্যবহারটা আশা করেছিল সবার আশা ভঙ্গ করে মোতালেব স্যার অতি হৃদয়বানের মতো আচরণ করলেন।

প্রথমে হাসিহাসি মুখ করে সবাই কেমন আছে জানতে চাইলেন। লাস্ট বেঞ্চের বদমাশ কয়েকটা ছেলে কানাকানি করছিল। স্যার সেটা দেখলেন অথচ কিছু বললেন না। সেটা দেখে আরো কয়েকজন ফিসফিস করা শুরু করে দিল। রোকন এতক্ষণ স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্যার বললেন, ‘কী ব্যাপার বাবাজি? ক্লাস থেকে পালাচ্ছিলে কেন?’

রোকন তখনো কিছুটা ত্রস্ত হয়ে আছে। স্যার আগে কখনো তাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলেননি। সব সময় তুই-তোকারি করতেন। রোকনের ধাতস্থ হতে সময় লাগল...

-সা-আ-আ-র...

- বলো কেন পালাচ্ছিলে?

- স্যার সবাই আমাকে অনেক জ্বালাচ্ছিল। আমাকে নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা করছিল।

- কেন? কী নিয়ে তামাশা করছিল?

কথাটা বলতে রোকনের আত্মসম্মানে লাগলেও কিছুটা সময় নিয়ে সে বলেই ফেলল পুরো ঘটনাটা। স্যার গম্ভীর হয়ে চোখবুজে রইলেন। তারপর বললেন, ‘যাও সিটে গিয়ে বসো। এরপর কেউ যদি তোমাকে নিয়ে কিছু বলে তাহলে হেড স্যারের কাছে কমপ্লেইন দিবা’। রোকন কিছুটা অবাক হলো। স্কুলে কোনো সমস্যা হলে কিংবা কেউ মারামারি করলে মোতালেব স্যার সব কিছুর শায়েস্তা করেন। তার কাছে হেড স্যারও চুনিপুটি। কিন্তু তিনি কেন হেড স্যারের কথা বললেন! তার কথা নয় কেন! রোকন আনমনে এসবই ভাবছিল, স্যার একটু কেশে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন...

‘শোন বাচ্চারা, তোমাদের একটা খবর দেই’, বলে তিনি রুমালে চোখ মুছলেন। ব্যাপারটা রোকনের কাছে ভালো লাগল না। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আগামী সপ্তাহ থেকে আমি আর তোমাদের পড়াব না। বদলি হয়ে অন্য স্কুলে যাব। আমার জায়গায় তোমাদের নতুন স্যার পড়াবেন। তোমরা সবাই মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। মারামারি, আরেকজনকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবে না।’

পুরো ক্লাস থমথমে হয়ে গেল। রোকন লক্ষ করল তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। স্যার আরো বললেন, ‘শুধু দুঃখের বিষয় এটাই যে, তোমাদের জন্যই আমার এ বদলি হচ্ছে। তোমাদের স্কুলেরি কেউ একজন অভিভাবক নিয়ে আমার নামে কমপ্লেইন করেছে। আমি নাকি তোমাদের ওপর অত্যাচার করি! মারধর করি! আরে বোকা, তোমাদের এই বেতটা দিয়ে মারার সময় প্রতিটা মার আমার বুকে লাগে। আমার কষ্ট হয়। তবু মারি শুধু এই ভেবে যে, এই শাসনের ফলেই তোমরা এক দিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে। তখন আমার এই জখম লাগা বুকটা গর্বে ভরে উঠবে।’

মোতালেব স্যার অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। ক্লাসের সবাই কাঁদতে শুরু করেছে। কেউ কেউ না কাঁদলেও মন খারাপ করে বসে আছে। রোকন সবার দিকে একবার করে তাকাল। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের দিকে তাকাতেই তার চোখ সেখানে আটকে গেল। সে দেখল স্কুলের সবচাইতে বদমাইশ আর গুন্ডা টাইপ ছেলে কয়েকটা মিটিমিটি হাসছে। মূলত এদেরকেই বেশি শায়েস্তা করতেন স্যার। রোকনের ঘটনাটা বুঝে ফেলতে আর বাকি রইল না।

পরদিন রোকন ক্লাসের কয়েকজনকে ডেকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল আর জানতে চাইল কী করা যায়! সবাই চিন্তিত হয়ে ভাবতে শুরু করল। মোতালেব স্যার তাদের শাসন করলেও তিনি নিতান্তই ভালো মনের মানুষ। তাকে কোনোভাবেই এই স্কুল ছেড়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। তখন দুষ্টু ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করবে কে! শাসন না পেয়ে তখন তো ওরা আরো বেড়ে যাবে! একেবারে মাথায় চড়ে বসবে। সবাই চিন্তা করতে করতে একসময় একটা সিদ্ধান্তে এলো। রোকন বলল, ‘তোরা সবাই কালকে তোদের বাবা-মাকে নিয়ে স্কুলে আসবি। আমিও আমার বাবা-মাকে নিয়ে আসব। সবাই মিলে হেড স্যারকে অনুরোধ করলে তিনি নিশ্চয়ই এতগুলো অভিভাবকের কথা ফেলতে পারবেন না! অবশ্যই তিনি কোনো একটা ব্যবস্থা নেবেন!’

সেদিনের মতো সবাই যার যার বাড়ি চলে গেল। পরদিন যাদের সঙ্গে রোকন মিটিং ডেকেছিল তারা সবাই অভিভাবক নিয়ে হাজির। রোকনও তার বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে হেড স্যারকে অনুরোধ করল মোতালেব স্যারকে যেন বদলি না করানো হয়। আর এটা যে একটা চক্রান্ত ছিল, সেটাও হেড স্যারকে জানানো হলো। হেড স্যার বিষয়টা নিয়ে ভাবার সময় নিলেন। কিছুদিন পর জানা গেলো যে, অবশেষে মোতালেব স্যারের বদলিটা স্থগিত করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close