তুফান মাজহার খান

  ২৭ জুলাই, ২০১৯

বনমফিজ

দুলাল দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে আগে আগে হেঁটে পুরোনো বাংলোর সিঁড়ির ওপর গিয়ে দাঁড়াল। পেছনে ঘুরে বলল, স্যার আপনে বাইরে বহেন আমি চেয়ার দিতাছি। কি রকম ময়লা আবর্জনায় ভইরা আছে দেখছেন স্যার। অসুবিধা নাই, আমি সব পরিষ্কার কইরা এক্কেবারে তকতকে কইরা দিতাছি। মিজান সাহেব বললেন, ঠিক আছে দুলাল। আমি বাইরেই বসি। তুমি কাজ কর।

মিজান সাহেব ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা। উনার অদ্ভুত এক চরিত্র। কখন কী বলেন, কী করেন, তার নেই ঠিক। যখন যা খেয়াল হয়, তাই করেন। তবে তিনি লোক ভালো। সবাই সজ্জন হিসেবেই উনাকে সম্মান করে। গোটা চাকরিজীবনে ১ পয়সা ঘুষ খায়নি কারো কাছ থেকে। আর কি মিষ্ট ব্যবহার। আজ বৃহস্পতিবার। আগামী ২ দিন অফিস ছুটি। তাই অবকাশযাপনের জন্য মধুপুর বনের মাঝে অবস্থিত একটি ২০০ বছরের পুরোনো বাংলোতে এসেছেন তিনি। সঙ্গে আছে তার ব্যক্তিগত সহকারী দুলাল মিয়া। মিজান সাহেব মাঝে মাঝেই অবকাশযাপনের জন্য এদিক-সেদিক বেরিয়ে পড়েন। তবে আজ যেখানে এসেছেন, সে জায়গাটা একেবারে নির্জন আর ঘন শালবনের মাঝে। বহু দিন এই বাংলোয় কেউ আসেনি, ওটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মাকড়সার জাল, শুকনো, লতাপাতায় ভরে আছে এটি।

সূর্য লাল হয়ে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। খানিকক্ষণ বাদেই দুলাল এসে বলল, স্যার সব ঝকঝকে কইরা দিছি। আপনে ভেতরে গিয়া বিশ্রাম নেন। আমি রাতের খাবারের জন্য কিছু বন্দোবস্ত করি। মিজান সাহেব বললেন, কিছু নিয়ে আসনি? দুলাল বলল, না স্যার। অসুবিধা নাই। মাইল দেড়েক উত্তরে একটা বাজার আছে। ঐখান থাইকা কিছু রুটি-পরটা নিয়া আসুম। মিজান সাহেব বললেন, ঠিক আছে। আমার টর্চটা নিয়ে যেও।

দুলাল চলে যাওয়ার পর মিজান সাহেব বাংলোর ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নেমে এলো। মিজান সাহেব ব্যাগ থেকে মোমবাতি আর দিয়াশলাই বের করলেন। এত বনের ভেতরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে মিজান সাহেব বিদ্যুৎ নেই বলেই জায়গাটাকে পছন্দ করেছেন। বিদ্যুৎ থাকলে যান্ত্রিক যান্ত্রিক পরিবেশ মনে হয়। মোমবাতি জ্বেলে একটা বই হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। ঘরে একটু গরম বেশি। পুরো রাতটা বাইরে কাটাতে পারলে ভালো হয়, ভাবছেন মিজান সাহেব। দুলাল আসলে দেখা যাবে এই ভেবে টেবিলে মোমবাতিটা রেখে বই পড়তে শুরু করলেন। উনার শখ এ দুইটাই। বই পড়া আর নানা জায়গায় গিয়ে অবকাশযাপন করা। হঠাৎ গলার খাকারি শুনে মিজান সাহেবের পড়ায় ছেদ ঘটল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখল অলম্বুস চেহারার অধিকারী এক ব্যক্তি। মিজান সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে ব্যক্তি লম্বা সালাম দিয়ে ওঠল। মিজান সাহেব উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? কী চান? লোকটি বলল, কিছু চাই না জনাব। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে আসলাম। অনেক দিন হলো কোনো মানুষজন পাই না কথা বলার জন্য। মিজান সাহেব বললেন, ঠিক আছে কথা বলেন, তবে আপনার পরিচয়টা তো দিলেন না। লোকটি বারান্দার মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় আমার নাই, তবে লোকজনে আমাকে বনমফিজ নামেই ডাকে। মিজান সাহেব বললেন, ও আচ্ছা, আপনিই তাহলে বনমফিজ। আপনার কথা লোকজনকে বলতে শুনেছি। দেখার শখ ছিল, আজ দেখলাম। মফিজ বলল, না আরো ভালো করে দেখুন। বলেই বনমফিজ বিশ্রী একটা হাসি দিল। এটা দেখে মিজান সাহেবের বুকটা একটু ধক করে উঠল। মিজান সাহেব বললেন, আচ্ছা মফিজ তুমি লোকালয়ে যাও না কেন? মফিজ বলল, লোকালয়ে তো জনাব মানুষ কম, চারদিকে অমানুষে ভরপুর। ছোট থাকতে এসব অমানুষের অত্যাচারে মা আমাকে নিয়ে বনে চলে আসে। বাপ-ভাই ছিল না বলে আমাদের সঙ্গে সবাই অত্যাচার, অনাচার করত। বাড়ি ভিটে লিখে দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যান আমাদের মারধরও করত। গায়ের লোকজনকে নিষেধ করে দিয়েছিল কেউ যেন আমাদের কাজ না দেয়। কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। শেষে খেতে না পেয়ে এই বনে ঢুকে পড়ি। বন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কখনো খালিপেটে থাকিনি। মিজান সাহেব বললেন, সো স্যাড! তা তোমার মা এখন কোথায়? প্রশ্ন শুনে বনমফিজের চোখে যেন জল এলো। মফিজ বলল, একবার প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। টানা পাঁচ দিন। আমাদের ঘর ছিল না। হিজল গাছের নিচে থাকতাম। ঐখানে বৃষ্টি একটু কম পড়ত। তার পরও পাঁচ দিনের বৃষ্টিতে যখন বন্যা হলো; তখন মা জ্বরাক্রান্ত হয়ে মারা গেল। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলাম না। বলতে বলতে মফিজের গাল বেয়ে চোখের জল নেমে এলো। মিজান সাহেব বললেন, থাক মফিজ, বাদ দাও ওসব কথা। শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে লাভ নেই। মফিজ বলল, আর কষ্ট! গরিবের কষ্ট সারা জীবন। তয় আরেকটা কষ্ট কী জানেন জনাব? আমার মা মরার পর প্রায় ১৫ দিন বন্যা ছিল। আমি গাছে গাছে থেকেছি, কিন্তু মাকে কবর দেওয়ার কোনো জায়গা পাইনি। অথৈ পানি। পানি কমতে কমতে মায়ের লাশ পচে-গলে শেষ। শুধু কিছু হাড়গোড় ছিল। তারপর আর সে হাড়গুলো মাটিতে পুঁতিনি, নিজের কাছেই রেখেছি। মিজান সাহেব চমকে ওঠে বললেন, বলো কী! মফিজ বলল, জি জনাব। দেখবেন? আমার এই পোঁটলাতেই আছে। মিজান সাহেব এবার অনেকটা ভয় পেয়ে বললেন, না, না। দরকার নেই। আমি দেখব না। তার পরও মফিজ বলেন, অসুবিধা নাই, দেখেন জনাব। এই বলে মফিজ তার পোঁটলায় হাত ঢোকাতেই একটা টর্চের আলো এসে পড়ল। মিজান সাহেব তাকিয়ে দেখলেন দুলাল খাবার নিয়ে আসতেছে। ওদিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে মফিজের দিকে তাকাতেই দেখলেন মফিজ উধাও। এবার চেয়ার ছেড়ে উঠেই গেলেন মিজান সাহেব। দুলাল এসে সালাম দিল। মিজান সাহেব বললেন, কী ব্যাপার! এত দেরি করলে কেন? দুলাল বলল, স্যার রাস্তা তো এক্কেবারে কম নয়। তাছাড়া খাবার নিয়া আসার সময় সেই উটকো মফিজটা আইসা হাজির। আমারে কয়, রুটি দে। আমি লাঠি দিয়া দিলাম দৌড়ানি। শালা বদমাইশ। মানুষকে খালি ডিস্টার্ব করে স্যার। মিজান সাহেবের চোখ যেন কপালে ওঠে গেল। ওমা তুমি কী বলো এসব? বনমফিজ তো এখন আমার এখান থেকে উঠে গেল। তুমি যাওয়ার পর তো আমি ওর সঙ্গেই এতক্ষণ গল্প করছিলাম। তুমি আসাতে সে উঠে কোথায় যেন চলে গেছে। দুলাল বলে, কী কন স্যার? মিজান সাহেব বললেন, হ্যাঁ তাই। তুমি কি সত্যি বলছো? আচ্ছা, মফিজ দেখতে কেমন? কী পরা ছিল? দুলাল বলল, স্যার মিথ্যার কারবার আমার কাছে নাই। মফিজের চেহারা দেখতে অলম্বুস। দাড়ি-গোঁফে একাকার। নীল রঙের একটা ছিঁড়া শার্ট পইরা আছিল। মিজান সাহেব বললেন, ঠিকই তো বললা, আমিও তো ঠিক এ রকমই একটা লোকের সঙ্গে এতক্ষণ ছিলাম। নামও বলল, বনমফিজ। দুলাল বলল, থাক স্যার। বাদ দেন। আপনেরে খাওন দিই? মিজান সাহেব বললেন, না। তোমার কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা আমাদের ঠিক হবে না। চলো, সব গুছিয়ে নাও। দুলাল সব গুছিয়ে বলল, চলেন স্যার। মিজান সাহেব বললেন, তার আগে খবারগুলো এখানে রেখে দাও। তা না হলে আমরাও যে অমানুষের কাতারেই পড়ে যাব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close